ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আশ শিফায় ইসরাইলের দৃষ্টি

আশ শিফায় ইসরাইলের দৃষ্টি

আশ শিফা হাসপাতাল গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ‘নিরাময় ঘর’। আর ইসরাইলিদের কাছে এটি হামাসের মূল আস্তানা। ৭ অক্টোবর ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরুর পর থেকে হাসপাতালটি বারবারই হামলার শিকার হয়েছে। গত সপ্তাহে হাসপাতালের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্সে ইসরাইলি সেনাবাহিনী হামলা চালায়। ওই অ্যাম্বুলেন্স গাজা নগরী থেকে রাফাহ সীমান্তের দিকে রোগীদের বহনকারী একটি গাড়িবহরের অংশ ছিল। ওই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মিসরে নেওয়া হচ্ছিল।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, হামলায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, অ্যাম্বুলেন্সে হামলার ঘটনাটিকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। এর মধ্যেই গতকাল সোমবার ইসরাইলি বাহিনী বলেছে, তারা আবারো ওই হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে। এবার একটি সৌর প্যানেল-ব্যবস্থাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ওই সৌর প্যানেল থেকে হাসপাতালের প্রধান বিভাগগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো।

‘দার আশ শিফা’র বাংলা অর্থ হলো, ‘নিরাময়ের ঘর’। এটি গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র। এখানে তিনটি বিশেষায়িত বিভাগ আছে। এগুলো হলো- শল্যচিকিৎসা (সার্জিক্যাল), সাধারণ চিকিৎসা (ইন্টারনাল মেডিসিন) এবং অবসটেট্রিকস ও গাইনোকলজি (স্ত্রীরোগ)। গাজার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা রেমালে হাসপাতালটির অবস্থান। মূলত সেখানে একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যারাক ছিল। ১৯৪৬ সালে এটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে মিসরের শাসনাধীন এবং ইসরাইলি দখলদারি চলার সময় এটিকে বিস্তৃত করা হয়। জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন, এমন মানুষদের কাছে হাসপাতালটি যেন প্রাণ সঞ্চারকারী। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) সম্প্রতি এক প্রতিবেদন অনুসারে, হাসপাতালটির ধারণক্ষমতা ৭০০ হলেও সেখানে চিকিৎসকরা প্রায় ৫ হাজার মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া ইসরাইলি হামলার কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া হাজারো মানুষ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ এবং এর করিডোরে আশ্রয় নেয়। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ ত্রাণ সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিচালিত আবু আসসি স্কুলে গত সপ্তাহে বোমা হামলা হয়। হামলার পর হাসপাতালটি হতাহতদের দিয়ে ভরে যায়। গত রোববার রাতে শাতি শরণার্থী শিবিরসহ গাজার উত্তরাঞ্চলে ৪৫০টি স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এরপর হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আশ শিফা হাসপাতালের শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রধান মারওয়ান আবু সাদা এক বিবৃতিতে বলেন, স্বাভাবিক দিনগুলোতে হাসপাতালে ২১০ রোগী ভর্তি হতে আসেন। ‘মেডিকেল এইড ফর প্যালেস্টিনিয়ানস (এমএপি)’ নামের একটি এনজিওর মাধ্যমে বিবৃতিটি পেয়েছে আল জাজিরা। হাসপাতালটিতে কর্মীর সংখ্যাও কমে গেছে। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বিমান হামলায় হাসপাতালটির ১৫০ চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। হাসপাতালের শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রধান মারওয়ান আবু সাদা ৮ নভেম্বর আল জাজিরাকে বলেন, ‘সব দিক থেকে আমরা এক স্বাস্থ্য বিপর্যয় মোকাবিলা করছি।’ আশ শিফা হাসপাতালে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে এমএসএফ। সম্প্রতি সংগঠনটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের শল্যচিকিৎসকরা বেদনানাশক ছাড়াই রোগীদের অস্ত্রোপচার করছেন। শয্যা ফাঁকা না থাকায় রোগীদের মেঝেতে শুইয়ে অস্ত্রোপচার করছেন। জায়গা ফাঁকা না থাকায় অস্ত্রোপচারের পর তাদের আলাদা করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখারও সুযোগ নেই। এতে রোগীদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে পানির প্রধান উৎস বলে বিবেচিত একটি লবণাক্ত পানি শোধনকেন্দ্র এবং ইসরাইল থেকে আসা একটি পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আশ শিফা হাসপাতালের অবস্থান গাজার উত্তরাঞ্চলে। হাসপাতালটিতে শুধু ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি সরবরাহ করা হয়। যা পান করার উপযোগী ও স্বাস্থ্যকর নয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, গাজায় যে পরিমাণ পানির চাহিদা আছে, তার মধ্যে শুধু ৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।আশ শিফা হাসপাতালটি ইসরাইলি বাহিনীর হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ইসরাইলি বাহিনীর দাবি, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সদর দপ্তরের ওপরে হাসপাতালটির অবস্থান। ২০০৭ সাল থেকে গাজার শাসন ক্ষমতায় আছে হামাস। গত মাসে ইসরাইলি সেনাবাহিনী একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এটি ছিল স্যাটেলাইট চিত্র এবং অ্যানিমেটেড গ্রাফিকসের সংমিশ্রণ। ভিডিওতে দাবি করা হয়, হাসপাতালটির নিচের অংশ হামাস ব্যবহার করছে বলে তাদের কাছে প্রমাণ আছে। তারা আরো দাবি করেছে, সেখানে হামাসের সুড়ঙ্গ, বৈঠককেন্দ্রসহ আরো বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা আছে। হামাস এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, সেখানে ৪০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। হামাস ও আশ শিফা হাসপাতালের মধ্যে যোগসূত্র থাকার ব্যাপারে এবারই প্রথম দাবি করা হয়নি। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযানের পর মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছিল, হাসপাতালটির পরিত্যক্ত এলাকাগুলোতে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে হামাস। মানবাধিকার সংগঠনটি আরও অভিযোগ করেছিল, গাজায় যুদ্ধাপরাধ করেছে ইসরাইল। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলি অভিযানের সময়ও হাসপাতালটি হামলার শিকার হয়েছিল। তখন হাসপাতালটিতে বিস্ফোরণে ১০ শিশু নিহত হয়। ওই বিস্ফোরণের জন্য ইসরাইল ও হামাস একে অপরকে দায়ী করেছিল। গত ৭ অক্টোবর গাজায় নতুন করে হামলা শুরুর পর ইসরাইল অভিযোগ করেছে, হামাস নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জ্বালানি সংরক্ষণ করছে। এ অভিযোগ তুলে গাজায় নতুন করে কোনো জ্বালানিবাহী গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরাইল। এতে গাজা উপত্যকার ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ১৬টিতে এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। সেখানকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ইসরাইলি বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে আশ শিফার পরিণতি ভালো হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। আল জাজিরায় প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছিল, তখন ইসরাইলি বাহিনী গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলকে উপত্যকার অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গাজা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে হামাসের যোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের লড়াই চলছে। ইসরাইল তখন বলেছে, তারা হামাসকে পরাজিত করতে চায়, হাসপাতালটির পাদদেশে থাকা হামাসের সদর দপ্তর ধ্বংস করে দিতে চায় এবং সংগঠনটির যোদ্ধাদের খুঁজে বের করে আটক করতে চায়। ইসরাইল আরো বলেছে, অদূর ভবিষ্যতে তারা গাজা উপত্যকায় নিরাপত্তার বিষয়টি তদারকি করতে চায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত