ফিলিস্তিনের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ কেন
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
যদি গাজায় চলমান যুদ্ধটি বাকি সব যুদ্ধগুলোর মত হতো, তাহলে এতদিনে হয়তো সেখানে অনেক কিছুর ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র দেখা যেত। সম্প্রতি সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়েছে; কিন্তু তখন হয়তো বহুদিন আগেই এ যুদ্ধবিরতি হতো। মৃতদের কবর দেওয়া হয়ে যেত। ইসরাইলকে হয়তো জাতিসংঘের সঙ্গে তর্ক করতে হতো, গাজা পুননির্মাণে ঠিক কী পরিমাণ সিমেন্টের দরকার হবে! কিন্তু এ যুদ্ধটা সেগুলোর মতো নয়। কারণ, এ যুদ্ধটা এমন সময় হচ্ছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করা ফল্ট লাইনে চিড় ধরেছে। গত দুই দশক ধরে এখানকার ভূরাজনীতির যে উত্তেজনাকর চিত্র, তার একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা। ইরানের এ নেটওয়ার্কের মূলে, যেটা কখনও পরিচিত ‘প্রতিরোধের জোট’ হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী, যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস এবং ইসলামি জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে।
একইসঙ্গে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে। গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরাইল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে, ততই এ দুই মিত্রগোষ্ঠীর কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে। ইসরাইল আর লেবাননের সীমান্তে ধীরে ধীরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে। ইসরাইল বা হেজবুল্লাহ কোনো পক্ষই অবশ্য সরাসরি যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যেহেতু দু’পক্ষ থেকেই উত্তজনা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই সেটা কোনো এক সময় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার ঝুঁকিটাও তৈরি হচ্ছে।
ইয়েমেনের হুতিরা ইসরাইলের দিকে তাক করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা ছুঁড়েছে। সে সবগুলোই অবশ্য প্রতিহত করেছে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেড সি’তে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর। ইরাকে, ইরান সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের কিছু অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যদিও সবপক্ষই উত্তেজনা যাতে খুব বেশি না ছড়ায়, সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সব সময়ই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আছে ইসরাইল, উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান ও মিশর। যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরাইলকে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে। যদিও এটা পরিষ্কার, ইসরাইল যে ব্যাপক পরিমাণে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে, সেটা নিয়ে অস্বস্তি আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন প্রকাশ্যেই বলেছেন, অনেক বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে।
উত্তর গাজা থেকে হাজারে হাজার ফিলিস্তিনির পালিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে হেঁটে দক্ষিণে যাওয়ার যে দৃশ্য, সেটা অনেককেই ১৯৪৮ সালে আরবদের বিপক্ষে ইসরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে সাত লাখেরও বেশি মানুষ ইসরাইলি বাহিনীর অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে, সেটাকে ফিলিস্তিনিরা আল নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। সেই ১৯৪৮ সালের শরণার্থীদের পরের প্রজন্মের বেশিরভাগই এখন গাজা উপত্যকার বাসিন্দা। আর কিছু উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক, তাদের অনেকের ফিলিস্তিনিদের ওপর আরেকটি নাকবা আরোপের মতো ভয়ংকর কথাবার্তা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শিবিরেরই কিছু আরব দেশ বিশেষ করে জর্ডান ও মিশরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এমনকি নেতানিয়াহু সরকারের একজন মন্ত্রী তো হামাসকে মোকাবিলা করার জন্য গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার ইঙ্গিতও দেন। তাকে তিরস্কার করা হলেও বহিষ্কার করা হয়নি। এসবকে পাগলের আলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু জর্ডান ও মিশরের বিষয়টা গুরুত্বসহই নিয়েছে। সেটা অবশ্য পারমাণবিক বোমার ব্যাপারে না হলেও, যেটা ইসরাইলের ঘোষিত ও অঘোষিত অনেকই আছে, বরং হাজার হাজার ফিলিস্তিনির তাদের সীমানায় ঢুকে পড়ার শঙ্কা তাদের বেশি। আর যদি গাজায় যুদ্ধের কথা বলা হয়, তাহলে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা বলেছেন, যুদ্ধ এবং তার পরবর্তি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে খুবই কঠিন এবং বিশৃঙ্খল। একমাত্র উপায় হবে, ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুনঃনির্মাণ করা।