ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। যা দিন দিন বাড়ছেই। উপত্যকাটিতে দেখা দিয়েছে এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়। ফলে ইসরাইলের নির্বিচার বোমা হামলা ও স্থল অভিযানের লাগাম টেনে ধরতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হচ্ছে। গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে ‘টেকসই যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। যদিও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইল সফররত ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনা দুই পক্ষের মধ্যে ‘অবিলম্বে ও স্থায়ী’ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। গত রোববার তেল আবিবে ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ক্যাথরিন বলেন, ‘অনেক বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছেন।’
গাজায় টেকসই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানালেনা বেয়ারবক। যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস পত্রিকায় লেখা এক যৌথ নিবন্ধে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ সংঘাতে অনেক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান দ্রুত, কিন্তু টেকসইভাবে শেষ করার জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ বেড়েছে।’ অবশ্য দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথাও লিখেছেন, এখনই তড়িঘড়ি সাধারণ যুদ্ধবিরতিতে সামনের পথ মসৃণ হবে বলে তারা বিশ্বাস করেন না।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের পক্ষে দেড় শতাধিক দেশ ভোট দেয়। তবে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গতকালও গাজার উত্তরাঞ্চলে তাদের হামলায় ২৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে সিএনএন জানিয়েছে। এ ছাড়া মধ্য ও দক্ষিণ গাজায়ও হামলার খবর পাওয়া গেছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরাইলের ভাষ্যমতে, এ হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের মতো নিহত হয়েছে। আর প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ওদিন থেকে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ১৮ হাজার ৮০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।
গাজায় হামাসের হাতে বন্দি থাকা নিজেদের তিন নাগরিককে ‘ভুল করে’ গুলি চালিয়ে হত্যার পর দেশের ভেতর ভীষণ চাপে পড়েছে ইসরাইলের সরকার। এমন প্রেক্ষাপটে বন্দি বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার আবারো আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় নিয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়েছে। উল্লেখ্য, ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে জিম্মি ও বন্দি বিনিময়ে মধ্যস্থতা করে আসছে কাতার ও মিসর। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একটি সমন্বিত ও টেকসই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে যুদ্ধ অবসানের প্রত্যাশা করছে কাতার।’
এদিকে গাজা নগরীর একমাত্র ক্যাথলিক গির্জা প্রাঙ্গণে গত শনিবার এক ইসরাইলি সেনার গুলিতে দুই নারী নিহত হয়েছেন। তারা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ও সম্পর্কে মা-মেয়ে। জেরুজালেমের লাতিন প্যাট্রিয়ার্কের কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, সন্ন্যাসী মঠের দিকে যাওয়ার সময় নাহিদা ও তার মেয়ে সামারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রথমে একজন গুলিবিদ্ধ হন, অপরজন তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপরদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলছে, তারা গাজা উপত্যকার একটি হাসপাতাল থেকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। একই হাসপাতাল থেকে ‘সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত’ প্রায় ৮০ হামাস সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার ইসরাইলি বাহিনী এসব কথা বলেছে। আর হামাস বলছে, হাসপাতালটিতে ‘ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ’ চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। বুধবার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ইসরাইলি বাহিনী কয়েক দিন ধরে গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। সেখানে তারা রোগীদের কক্ষে গুলি ছুড়েছে এবং কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা (ওসিএইচএ) বলেছে, একই দিন হাসপাতালের বাইরের অজ্ঞাত স্থান থেকে হাসপাতালের পরিচালক এবং আরো প্রায় ৭০ চিকিৎসাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। ওসিএইচএ আরো বলেছে, ইসরাইলি বাহিনী পাঁচ চিকিৎসক ও নারী কর্মীকে মুক্তি দিয়েছে। তবে যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, কামাল আদওয়ান হাসপাতাল এলাকায় তাদের কর্মকাণ্ডের সমাপ্তি টানা হয়েছে। ওই হাসপাতালটিকে হামাস নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। ইসরাইলি সেনাবাহিনী আরো বলেছে, তাদের সেনারা প্রায় ৮০ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ওই এলাকায় তাদের সন্ত্রাসী অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করেছে। হাসপাতাল থেকে ‘বিপুলসংখ্যক অস্ত্র’ উদ্ধার হয়েছে বলেও দাবি তাদের। হাসপাতালের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে উল্লেখ করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, ‘ওই কর্মীরা স্বীকার করেছেন, অস্ত্রগুলো ইনকিউবেটরে (অপরিণত শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত) লুকানো ছিল। এদিকে শনিবার এক বিবৃতিতে হামাস অভিযোগ করেছে, ইসরাইলি সেনারা হাসপাতালটির ভেতর ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষদের তাঁবুগুলো বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ ঘটনায় কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে।