হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ : আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২০২৩ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলা যায় ইসরাইলে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণের ঘটনা। ৭ অক্টোবর ইসরাইলে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হামলা চালায় হামাস। রকেটের পর রকেট হামলা ছাড়াও হামাস যোদ্ধারা শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙে ইসরাইলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইসরাইলের ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়, ২৪০ জনকে বন্দি করা হয়। প্রশ্ন ওঠে ইসরাইলের সুনিপুণ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুরু করেন তার নিজের ভাষায় ‘ভয়ংকর প্রতিশোধ’। ইসরাইল এরপর গাজায় পাল্টা হামলা করতে শুরু করে। পরের তিন মাসজুড়ে ইসরাইল গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মাঝে এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি হয়। হামাসের হাতে বন্দি ১১০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরাইলে বন্দি ২৪০ জন ফিলিস্তিনিকেও মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর আবারও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গাজায় ১৯ লাখ বা প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। ফিলিস্তিনিরা এটিকে আরেক ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে জোরালো সমর্থন জানালেও ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মৃত্যুতে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে সেদিকেও। ওদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি ভেস্তে যাওয়ায় এ হামলার পেছনে ইরানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। জাতিসঙ্ঘ, আরব বিশ্ব থেকে শুরু করে প্রায় সবাই সাধারণ জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে নিন্দা জানিয়ে আসছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে পাস হলেও এখনও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি।
তুরস্ক, সিরিয়া ও মরক্কোর ভূমিকম্প : ২০২৩ সালে বেশ কিছু ভূমিকম্পের ঘটনা উঠে এসেছে সংবাদের শিরোনামে। এর মাঝে সবচেয়ে আলোচিত তুরস্ক-সিরিয়া ও মরক্কোর ভূমিকম্পের ঘটনা। ৬ ফেব্রুয়ারি সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের কাছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার ধরে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। যার কারণে ভবনগুলোতে মারাত্মক ক্ষতি হয়। তুরস্ক ও সিরিয়া মিলে মৃত্যু হয় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। গৃহহীন হয় লাখো মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার জন্য বিষয়টি আরো বেশি কঠিন হয়ে যায়। কারণ, বিধ্বস্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলটি ছিল বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত। যেটি ভূমিকম্পে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিল দেশটি। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি আফটারশক চলতে থাকে। যার মধ্যে দুটির মাত্রা ছিল ৬.৮ ও ৫.৮। আর মরক্কোতে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে ৮ সেপ্টেম্বর রাতে। মৃত্যু হয় প্রায় ৩০০০ মানুষের। ক্ষতিগ্রস্তদের একটা বড় অংশ দুর্গম এলাকায় হওয়ায় উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ পৌঁছাতে বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের মদিনার বিভিন্ন অংশ এবং অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটন আকর্ষণ কুতুবিয়া মসজিদের মিনার। এর প্রায় ১ মাস পরে ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে ৬.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত করে। যাতে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ বছর পূর্ণ হয়। তবে যুদ্ধের খবর ততদিনে কিছুটা পুরনোই হয়ে এসেছে বিশ্বজুড়ে। তবে বড় আলোচনা সৃষ্টি হয় জুন মাসে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করা ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহের ঘটনায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সমালোচনা আগে থেকেই করে আসছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার ভেতরে সরাসরি বিদ্রোহকে ‘পিঠে ছুরিকাঘাত’ বলে বর্ণনা করেন পুতিন। একটি সমঝোতার মধ্য দিয়ে মুখোমুখি অবস্থার অবসান হলেও এরপর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে আর দেখা যায়নি প্রিগোশিনকে। প্রিগোশিন প্রতিশোধের শিকার হতে পারেন বলে জুলাই মাসে উল্লেখ করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। তবে তিনি আবারও খবরের শিরোনাম হন ২৪ আগস্ট, যখন তাকে বহনকারী বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে তার মৃত্যু হয়। বিমান বিধ্বস্তের পেছনে ক্রেমলিনের হাত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও তা অস্বীকার করেছে রাশিয়া। তবে আগের বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ সবচেয়ে বড় প্রভাব সৃষ্টি করেছে বিশ্বের অর্থনীতিতে। বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় বাড়তি চাপের। পশ্চিমা মিত্ররা একসময় ইউক্রেনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছিল। এ বছর তারাও ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। তবে ধুকতে থাকা ইউক্রেন যুদ্ধ যেন আরেকটি বড় ধাক্কা খায় হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। নতুন এ যুদ্ধ সবার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে। ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। আরো কতদিন চলবে বা কীভাবে শেষ হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
ভারত-কানাডা দ্বন্দ্ব : কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের একটি শিখ মন্দিরের বাইরে ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করা হয় কানাডার শিখ নেতা হারদিপ সিং নিজ্জারকে। তবে এটি বড় ঘটনায় রূপ নেয় যখন এ হত্যার পেছনে ভারত সরকারের হাত থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ১৮ সেপ্টেম্বর কানাডার হাউজ অব কমন্সের সভায় ট্রুডো বলেন, কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা নিজ্জারের হত্যার সঙ্গে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ভারতে। অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভারত এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে। একই সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের’ আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে কানাডার বিরুদ্ধে। সম্পর্কের অবনতি ঘটে দুই দেশের মধ্যে। তবে ডিসেম্বর মাসে নতুন অভিযোগ আসে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ‘খালিস্তান আন্দোলনে’ থাকা মার্কিন নাগরিক গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয় দিল্লির বিরুদ্ধে। দিল্লি এটিও অস্বীকার করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তোলার পরে ভারতের দিক থেকে কিছুটা সংযমী বক্তব্য পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন ট্রুডো। কানাডার সঙ্গে টানাপড়েন কেটে যাওয়ার মতো বিশেষ কিছু না ঘটলেও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না, বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড : এ বছরের জুলাই মাসে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় জলবায়ু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র কোপার্নিকাসের হিসাব অনুযায়ী এ বছরের ৬ জুলাই গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ছিল ১৭.০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইতিহাসে এই প্রথম গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির ওপর উঠেছে। এবার তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা পার করেছে ইউরোপ-আমেরিকার কিছু অঞ্চল। যেখানে মানুষ শীতের সঙ্গে বেশি অভ্যস্ত। ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা ঘটেছে কানাডা, গ্রীস, চিলি, আমেরিকার হাওয়াইয়ের একটি দ্বীপে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা উচ্চতম রেকর্ড ছুঁয়েছে। যার একটা প্রধান কারণ ছিল ‘এল নিনো’ নামে প্রাকৃতিক আবহাওয়া চক্র। অতি উত্তপ্ত এই বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আজারবাইজানের নাগোর্নো-কারাবাখ দখল : সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সুর এখন পর্যন্ত বেজে চলেছে পূর্ব ইউরোপজুড়ে। আজারবাইজানের নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে মূলত আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। তারা কখনোই আজারবাইজানের শাসন মেনে নিতে চায়নি। ১৯৯১ সালে আর্মেনিয়ানরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর ফলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি সম্পাদিত হলে আর্মেনীয়রা স্বাধীনতা অর্জন করে। আজারবাইজানের কাছ থেকে কিছু অঞ্চলও লাভ করে। ২০২০ সালে অঞ্চলটিতে আবারও যুদ্ধ শুরু হয়। এবারও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি সম্পাদিত হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আজারবাইজান আবারো আক্রমণ করে। এবারের আক্রমণে আজারবাইজান পুরো নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল দখল করে নেয়। প্রায় এক লাখ আর্মেনীয় নাগরিক আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধ ২০২৪ সালেও চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সৌদি-ইরান সম্পর্ক, আরব লীগে সিরিয়া : এ বছরের আলোচিত একটি ঘটনা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৈরি দেশ ইরান আর সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এপ্রিল মাসে বৈঠকের ঘটনা। যার মধ্যস্থতা করেছিল চীন। ৭ বছর পর দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে বৈঠক হয়। দুই দেশ তাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে রাজি হয়। চীনের জন্য এটিকে একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হয়। আবার মে মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের আরব লীগে পুনরায় যোগদানও ছিল আলোচিত বিষয়। ২০১১ সালে নৃশংস গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশটিকে এ আঞ্চলিক ফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তখন থেকে প্রেসিডেন্ট আসাদ ওই অঞ্চলে একঘরে হয়েছিলেন। তবে সৌদি আরবের জেদ্দায় আরব লীগের সম্মেলনে তিনি যেভাবে প্রবেশ করেন এবং সৌদি যুবরাজ যেভাবে তাকে বরণ করে নেন, সেটি সিরিয়ার যুদ্ধে তার বিজয়ের এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হয়।
আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান : মধ্য ও সাব-সাহারান পাঁচটি দেশে এ বছর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। দেশগুলো হলো- নাইজার, সিয়েরা লিয়ন, গ্যাবন, বুরকিনা ফাসো ও গিনি বিসাও। এ ছাড়া সুদানে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সবকিছু মিলে মহাদেশটিতে গণতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রুশ মিলিশিয়া বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর জানা গেছে, সাব-সাহারান দেশগুলোতে তারা কতটা প্রভাবশালী ছিল। সামরিক অভ্যুত্থানগুলোকে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। কারণ, সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে নির্বাচিত নেতাদের বেশিরভাগ জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ প্রাধান্য দিতেন।