ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস হামলা চালায়। এরপর শুরু হয় গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা। প্রায় চার মাস ধরে চলা এ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ২৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ২০২৪ সালের শুরুতে এসেও ইসরায়েলের হামলা থামানোর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। দুই দিকেই লড়াইয়ে মৃতের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই।
ইসরায়েল শুরু থেকে বলে আসছে, তাদের লক্ষ্য হলো হামাসের সামরিক ক্ষমতা ও শাসনক্ষমতার অবসান ঘটানো। আর এ লক্ষ্যে তারা গাজা উপত্যকার ওপর কোনো ধরনের বিরতি না দিয়ে নির্বিচার আকাশ থেকে বোমা হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইসরায়েল বলছে, এখন পর্যন্ত তারা এ মিশনে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও তারা দাবি করছে, লক্ষ্য অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা কি তাদের দাবিকে সমর্থন করছে? উত্তরটা মনে হয় খুব সহজে বলা যাচ্ছে না। এ সংঘাতের বিভিন্ন দিক নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হামাস ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য পেয়েছে বেশি।
হামাস টিকে ছিল ও আছে : হামাস এখনও অনেক সক্রিয় ও পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে। আইনিভাবে এ সংগঠন বৈধ না হলেও বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিকভাবে এ সংগঠন স্বীকৃত। গাজা যতই ধ্বংস হোক না কেন, এ উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র সত্তা হিসেবে তারাই টিকে আছে। পরোক্ষভাবে এ সংগঠনের উদ্যোগেই আলোচনার মধ্য দিয়ে এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি আদায় হয়েছিল। এমনকি ইসরায়েলি বন্দিদের ফেরত দিয়ে স্বল্পসংখ্যক হলেও আটক ও জিম্মি ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে আনতে পেরেছে তারা।
আর বাকি জিম্মিদের যতদিন তারা ধরে রাখবে, হামাস ততদিন অনিবার্যভাবে ‘অন্য পক্ষ’ হয়ে থাকবে। তাদের ছাড়া অন্য জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনা কঠিন। ইসরায়েল বরাবরই বলে আসছে, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় বেসামরিক স্থাপনায় হামাসের কোনো জায়গা নেই। কিন্তু তারা কখনোই বিকল্প কী হতে পারে, তেমন পরিকল্পনার কোনো আভাস দেয়নি। নানা ধরনের কথা বলা হয়, হামাস ছাড়া গাজার ভবিষ্যৎ ভালো হবে। কিন্তু হামাসকে কীভাবে হটানো যাবে বা তাদের বিকল্প কে হবে, তেমন কোনো কথা কেউ স্পষ্ট করে বলেনি। যুক্তরাষ্ট্র, কিছু আরব দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ফাতাহ বা আরব-বিশ্বের (প্যান আরব) বাহিনীর হাতে। কিন্তু কীভাবে এটা হবে, সে বিষয়ে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা পেশ করেনি। এখন যে যা বলছে, তা হলো নিজেদের মনোবাসনা। কিন্তু যে ভবিষ্যৎ অনুমান করা হচ্ছে, তা হলো হামাস টিকে থাকবে।
হামাস এখনো সক্রিয় সামরিক বাহিনী : বাহিনীর দ্য মিলিটারি উইং হলো দ্য কাসেম ব্রিগেডস। এ সামরিক শাখা এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে তাদের গঠন প্রণালি, সংগঠন বা সদস্য সংখ্যা নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। সাধারণত যেসব তথ্য পাওয়া যায় এবং ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, আরব ও রাশিয়ার সূত্র থেকে ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, কাসেম ব্রিগেডসে ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। এমনকি বিশ্লেষকরা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বাহিনীর সম্মুখসারিতে সুপ্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল ও আদর্শিকভাবে অত্যন্ত অনুগত এমন অন্তত ১৮ হাজার সদস্য রয়েছে। বাকিরা পেছনের সারিতে।
অনেক ইসরায়েলি দাবি করেন, তারা ১০ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। অবশ্য এটা অতিরঞ্জিত বলেই মনে করা হয়। কাসেম ব্রিগেডস অনেক সদস্য হারিয়েছে সত্য, তবে তাদের প্রায় সব ব্যাটালিয়নেও বেশ সক্রিয় যুদ্ধ ইউনিট রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ পরিচিত ও প্রভাবশালী চিন্তক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ৭ অক্টোবরের হামলায় হামাসের ২৬ থেকে ৩০টি ইউনিট অংশ নিয়েছিল। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে ৪০০ থেকে ১ হাজার সদস্য রয়েছে। চলমান এ যুদ্ধের মধ্যে মাত্র তিনটি ধ্বংস হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে চার বা পাঁচটি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এর মানে এ নয়, তাদের শক্তি কমে গেছে। তারা হয় একা বা অন্যদের সঙ্গে মিশে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
ডেপুটির অধীনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে : একদিক দিয়ে হামাসের সামরিক উইং ব্যতিক্রমভাবে নিজেদের কার্যকর প্রমাণ করেছেন। যেসব ইউনিটের কমান্ডাররা মারা গেছে, সেসব ইউনিট তাদের ডেপুটির অধীনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মাঠের পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে অন্তত পাঁচ ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া নর্দান ব্রিগেডের কমান্ডারসহ ছয়জন যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছেন। এরপরও কোনো ইউনিট কিন্তু নেতৃত্বহীন হয়ে যায়নি, অকার্যকর হয়ে পড়েনি। উল্টো হামাস দেখিয়েছে যোগ্য ডেপুটি গড়ে তোলার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। ইসরায়েল যেখানেই হামাসের সুড়ঙ্গ দেখেছে, সেখানেই সেগুলোর প্রবেশদ্বার বন্ধ বা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু হামাসের যে এখনো অনেক ভূগর্ভস্থ স্থাপনা আছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কারণ, হামাস অনেক সময় নিজেদের বাহিনীর সদস্যদের সামনের দিক থেকে সরিয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গিয়ে শত্রুপক্ষের ওপর চড়াও হচ্ছে।
অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাহায্য পাচ্ছে হামাস : গাজা থেকে যেসব প্রতিবেদন আসছে, তাতে মনে হয়, হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসেম ব্রিগেডস একাই লড়াই করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আদর্শিক ব্লকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠী লড়াই করছে। এদের সংখ্যা ১২টির কম হবে না। কাসেম ব্রিগেডের পরই যাদের নাম শোনা যায়, তারা হলো ইসলামিক জিহাদ। আরও রয়েছে পপুলার রেসিসট্যান্স কমিটি, লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের দুটি শাখা, যার একটি পপুলার ও আরেকটি ডেমোক্রেটিক নামে পরিচিত। সম্ভবত হামাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে কম সম্ভাবনা রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সশস্ত্র শাখা আল আকসা শহিদ ব্রিগেডের।
কিন্তু তারাও কাসেম ব্রিগেডসের জেনারেল কমান্ডারের অধীনে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। প্রয়োজনের তাগিদে সবাইকে হামাসের ছাতার নিচে রাখা হলো বাস্তবসম্মত সমাধান। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো উত্তেজনা বা ফাটল দেখা যায়নি। এ লড়াইয়ের মধ্যে ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর চাপের মুখে ছোট কোনো ইউনিট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা ছেড়ে গেছে বা শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। উপরন্তু তাদের মধ্যে কেউ হয়তো কাসেম ব্রিগেডসের সঙ্গে একীভূতও হয়ে যেতে পারে, অন্তত সাময়িক সময়ের জন্য; এমনটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। একই হুমকির মুখে সব সশস্ত্র গ্রুপের সহাবস্থান নিঃসন্দেহে হামাসের একটি সাফল্য।
পশ্চিম তীরে জনপ্রিয়তা বেড়েছে হামাসের : গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলার পর ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের চোখে হামাস সন্ত্রাসী ও বেসামরিক মানুষদের হত্যাকারী সংগঠন। কিন্তু এ ঘটনাই অনেক ফিলিস্তিনি ভিন্নভাবে দেখছে। যারা সব সময় নিজেদের ইসরায়েলের নিপীড়ন-নির্যাতন, বিভেদ, অনাচার ও বৈষম্যের শিকার হতে দেখে এসেছে, তাদের বেশির ভাগই হামাসকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় একমাত্র অকুতোভয় দল হিসেবে মনে করে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির (দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধান) পর যাদের জন্ম, সেসব ফিলিস্তিনি দেখছেন সেই চুক্তি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারেনি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এ হতাশাটা বেশি ফাতাহশাসিত পশ্চিম তীরে। অনেক তরুণ-তরুণীর দৃষ্টিতে ফাতাহ অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত, অক্ষম ও ফিলিস্তিনের জন্য কাজ করতে অনাগ্রহী সংগঠন। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান হামলা, হয়রানি, লুটপাট ফিলিস্তিনি জনগণকে আরো বেশি হামাসের দিয়ে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে।
হামাসের দুঃখের চেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ আছে : গাজার যুদ্ধে পশ্চিম তীরের অনেক ফিলিস্তিনি প্রকাশ্যে ফাতাহের পতাকার পাশাপাশি হামাসের পতাকা উড়িয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। প্রাচীরঘেরা খণ্ডিত পশ্চিম তীরে ফাতাহের সব সময় এমন নিষ্ক্রিয় অবস্থান তরুণদের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এখন হামাসকে তাদের আশা-প্রত্যাশার প্রতীক মনে করছেন। কারণ, ইসরায়েলি শক্তি সম্পর্কে জানার পরও তাদের বিরুদ্ধে হামাস উঠে দাঁড়িয়েছে, লড়াই করেছে ও ইসরায়েলকে জবাব দিয়েছে। যদিও তরুণদের এ দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিতে হেরে যেতে পারে বা বহির্বিশ্বের অনেকের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টের হতে পারে; তারপরও এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটিই সত্য। এরপরও যদি ইসরায়েল হামাসকে ‘শেষ করে’ দেওয়ার লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়ও, তারপরও অনেক ফিলিস্তিনির মনে হামাসকে এমন একটি দল হিসেবে জায়গা করে নেবে, যারা নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকেনি। ইসরায়েলের হামলার মুখোমুখি হয়েছিল তারা। মনে হচ্ছে, গাজায় অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া এবং পশ্চিমাদের কাছে ভাবমূর্তি নেতিবাচক হওয়ার পরও দুঃখ পাওয়ার চেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার অনেক বেশি কারণ আছে হামাসের।
সূত্র : আল জাজিরা