আজ থেকে চার হাজার বছর আগের কথা। পৃথিবীজুড়ে ছিল শুধু মরুভূমি। অল্প কিছু মানুষের বসবাস। তাদের ইবাদতগাহ হিসেবে নির্মিত হয় কাবা শরিফ। যা প্রাথমিকভাবে আদম (আ.)-এর হাতে গড়ে ওঠে। কেটে গেল কয়েক বছর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। প্রয়োজন পড়ল আরেকটি মসজিদের। তৈরি হলো মসজিদুল আকসা। খুব বেশিদিনের ব্যবধানে নয়। এ দুভয়ের মাঝে ব্যবধান ৪০ বছর। (বোখারি : ৩৩৬৬)। তখন আল আকসার পাশে ছিল আরবের শাখা কেনানি ও জিবুতিদের বসবাস। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালে তারা আল আকসার আশপাশে বসবাস করত। সেখানে তারা দুর্গও নির্মাণ করে। এরপর মধ্যব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০-১৫০০)-এ ইবরাহিম (আ.) ইরাক থেকে আগমন করেন আল আকসার ভূমিতে। (খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ সালে) তার মাধ্যমে সেখানে তাওহিদের প্রকাশ ঘটে। তবে এ যুগে আল আকসার সংস্কার বা পুনর্র্নিমাণের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না।
আল আকসার গুরুত্ব : ইসলামে আল আকসার গুরুত্ব অপরিসীম; যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ১৬ হিজরি মোতাবেক ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বিজিত হয় আল আকসা। কিন্তু খ্রিষ্টান শাসক ও পাদ্রীদের বেয়াদবিমূলক অবহেলায় এ স্থানটি অনাবাদ পড়ে থাকে। ময়লার আস্তরণ পড়ে স্তূপ হয়ে যায়। ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর মেরাজের বাহন বোরাক বাঁধা পাথরের পাশে নামাজ আদায় করেন। সেখানে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। আদেশক্রমে কাঠ ও খড়পাতা দিয়ে নির্মিত হয় মসজিদুল আকসা। ২৬ বছর আল আকসার অবকাঠামো এমনই রয়ে যায়। তারপর আসে উমাইয়া খেলাফত। ৪১-১৩২ হিজরিতে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি মুআবিয়া (রা.)-এর মাধ্যমে এর গোড়াপত্তন হয়।
আল আকসার বসন্তকাল : উমাইয়া খেলাফতকাল ছিল আকসার জন্য বসন্তকাল। তখন ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক মুসলিমজাহানের খলিফা। মদিনা থেকে খেলাফতের রাজধানী সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় আল আকসা। তখন খলিফা আল আকসার পুনঃনির্মাণ করেন। কয়েক বছর বিরামহীন কাজের পর তৈরি হয় আজকের জাঁকজমকপূর্ণ আল আকসা। যা আজও উমাইয়া খলিফাদের অমর কীর্তি হিসেবে ইতিহাসের বুকে স্বর্ণাক্ষরে খচিত। যদিও পরবর্তীতে মুসলিম শাসকগণ সংস্কার ও সাজসজ্জার ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৩২ হিজরিতে উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে।
আব্বাসি খেলাফতে আকসার অবস্থান : শুরু হয় আব্বাস খেলাফত। তখন খেলাফতের রাজধানী দামেশক (যা ফিলিস্তিনের কাছে) বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়। ফলে আল আকসার গুরুত্ব অনেকখানি চোখের আড়াল হয়ে যায়। এ সুদীর্ঘ সময়ে আল আকসার ওপর অনেক ঝড়-তুফান বয়ে যায়। আল আকসা ও তার ভূমি (জেরুজালেম) নিয়ন্ত্রণে হাতবদল হয়। গত হয় এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। ক্ষমতার মসনদে একে একে পার হয় আহমদ ইবনে তুলুনের তুলনী শাসন। তারপর থেকে ৩৮ বছর ইখশিদিরা আল আকসা ও তার ভূমির নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় আল আকসা যথেষ্ট গুরুত্ববহ অবস্থানে বিবেচিত হয়। এতটাই গুরুত্ব দিত তারা যে, কোনো খলিফার মৃত্যু হলে দাফন করতে আকসায় নিয়ে যেত। ৩৪৯ হিজরিতে তাদের পতন হয়।
আকসার অবাক দখলদার : এবার আল আকসা ও তার ভূমির বাগডোর দখল করে উবাইদিয়ারা। তারা ছিল নিকৃষ্টতম শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। এরপর এগারো শতকে (৪৯২ হিজরি মোতাবেক ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) ইউরোপের ক্রুসেডাররা পুনরায় এ শহরটি দখলে নেয়। ঘোড়ায় চড়ে তারা আল আকসায় প্রবেশ করে। মুসলমানদের ওপর চালায় নির্যাতনের স্টিমরোলার। ৭০ হাজার মুসলমানকে মসজিদে আকসায় জবাই করে পবিত্র শহরে রক্তের বন্যা ব?ইয়ে দেয়। যা মানবতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বহুসংখ্যক মুসলমানকে জবাই করে হত্যা করে। মসজিদকে ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়ে ঠাট্টাস্বরূপ ‘আস্তাবলে সুলেমানি’ নামে ডাকতে শুরু করে। ৮০ বছর খ্রিষ্টানদের অধীনে থাকার পর ৫৮৩ হিজরিতে ইসলামের সাহসী সৈনিক সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির হাত ধরে আল আকসা ও আল কুদস মুসলমানদের হস্তগত হয়। ক্রুসেডাররা আল আকসাকে এতটাই অপবিত্র করে রেখেছিল, তা পরিষ্কার করতে এক সপ্তাহ লেগে যায়। মহাবীর সালাহুদ্দিন আইয়ুবি এ বছর আল আকসায় ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। তিনি মসজিদে আকসাকে পুনঃনির্মাণ করে সেখানে ব্যাপকভাবে মসজিদ-মাদরাসা ও ওয়াকফ স্টেট প্রতিষ্ঠা করেন।
আকসার ক্রান্তি যুগ : আব্বাসি খেলাফত তখনও শেষ হয়নি, এর মাঝে ক্রুসেডাররা আল আকসা ও তার ভূমি নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়। ছলে-বলে-কৌশলে ছিনিয়ে নিয়ে নষ্ট করে পবিত্রতা। এ প্রেক্ষিতে ৬২৮ হিজরিতে ফিডারিক আল কুদস ছিনিয়ে নেয়। যদিও চুক্তিতে ছিল আল আকসা ও কুব্বাতুস সাখরা থাকবে আব্বাসিদের হাতে। ১১ বছর পরে আল কুদস মুসলমানদের হাতে আসে। যা পুনরুদ্ধার করেন সুলতান নাজিমুদ্দীন আইয়ুব। এরপর থেকে আল আকসা সাত শতাব্দীব্যাপী মুসলমানদের হাতেই থাকে। কিন্তু ১৩৩৫ হিজরিতে ব্রিটিশ বাহিনী আল কুদসে প্রবেশের মাধ্যমে সে ধারার অবসান ঘটে। যদিও উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই তারা আল আকসা ও আল কুদস দখলের জন্য উঠে পড়ে লাগে। শতভাগ সফলতার হাতছানি দূর থেকেই পেতে আরম্ভ করে। সে সময়কাল ছিল উসমানি খেলাফতের। ইহুদিরা ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় উসমানি খেলাফতে। মজলুম খলিফা আবদুল হামিদ ছিলেন মুসলিমজাহানের খলিফা। এক মুষ্টি মাটির জন্য ওৎপেতে থাকে তারা।
বিশ্ব কুফফার শক্তির তৎপরতা : ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থায়ীভাবে আবাস করে দিতে উঠে পড়ে লাগে বিশ্ব কুফফার শক্তি। তখন মজলুম খলিফা সেই ঐতিহাসিক উক্তি করেন, যতদিন উসমানি খেলাফত থাকবে, ততদিন ইহুদিরা ঠাঁই পাবে না ফিলিস্তিনে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেখানে কৌশলগতভাবে উসমানি খেলাফতকে ঠেলে দেওয়া হয়। অনেক ধকল সহ্য করে, চক্রান্তের ফাঁদে জর্জরিত হয়ে উসমানি খেলাফতের বিষবৃক্ষ কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফতের পতন হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেনের সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল নামক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। ১৯৬৭ সালের ৭ জুন অভিশপ্ত ইহুদিরা বাইতুল মাকদিসকে করায়াত্ত করে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে মুসলমানের লড়াই চলমান।