বাংলাদেশে যেভাবে স্থায়ী হলো বিশ্ব ইজতেমা
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী ঢাকা লাগোয়া টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারি মাসে এ জমায়েত বাংলাদেশে হয়ে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। লাখো মানুষ এতে অংশ নেন। যাদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। হজের পর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েত এ বিশ্ব ইজতেমা। তাই একে বলা হয় মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় জমায়েত। এর গোড়াপত্তন হয় ভারতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে হয়ে আসছে। ১৯২৬ সালে হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলিগি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলিগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে। উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সূত্র ধরে উপমহাদেশের ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের অবস্থান সাপেক্ষে তাবলিগের তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালের দিকে যখন এটি শুরু হয়েছিল, তখন আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল ভারতে। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা শুরু হয়েছিল। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া চলছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে যারা অন্য ধর্মে যাচ্ছিল, তাদের আবারো হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। দেওবন্দকেন্দ্রীক মুসলমানরা চিন্তা করলেন, মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরো সচেতন করে তুলতে হবে। এটাকে আন্দোলন বলা হয় এ অর্থে, যখন একটা গোষ্ঠী অনেক লোক নিয়ে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত হয়, তখন সেটা আন্দোলনের রূপ নেয়।
ইজতেমার বাংলাদেশপর্ব যেভাবে : ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে এর সূত্রপাত হয় চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে। চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর দিয়ে হজে যাওয়ার জন্য মানুষ সেখানকার হজক্যাম্পে জড়ো হতেন। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আঞ্চলিক ইজতেমার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে প্রথম তাবলিগের জামাত নিয়ে আসেন তাবলিগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর ছেলে হজরত মাওলানা ইউসুফ (রহ.)। ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ করছিলেন তিনি। ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর হজরত ইউসুফ (রহ.) দু’দেশেই জামাত পাঠানো শুরু করলেন ইজতেমা আয়োজনের জন্য। তবে তখন ছোট আকারে ইজতেমা হতো। ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার রমনা পার্কের কাছে কাকরাইল মসজিদ। যেটা সে সময় মালওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে এ সম্মেলনটা হয়। এরপর হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন ১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি জামাত আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মো. খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বর্তমানে তাবলিগ জামাতের শুরা কমিটির একজন উপদেষ্টা। এখন যেভাবে বিদেশ থেকে প্রচুর মুসলমান ইজতেমায় অংশ নেন, সে সময়ে অবশ্য অন্যান্য দেশ থেকে লোকজন আসেনি বলে জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিল, আর ছিল গ্রামের মানুষ। ঢাকার পর হজরত ইউসুফ (রহ.) বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন। তাবলিগের জমায়েতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। এর পরের বছর ঠিক করা হয় ইজতেমা হবে টঙ্গীর তুরাগ নদের কাছে। আরো পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীতেই ১৬০ একর জমি নির্ধারণ করে দেন ইজতেমার জন্য।
বিশ্ব ইজতেমা নাম যেভাবে হলো : ‘বিশ্ব ইজতেমা’ তাবলিগের দেওয়া নাম নয়, বরং তাবলিগের লোকজন এটাকে বার্ষিক সম্মেলন বলতেন। তাবলিগ জামাতের পক্ষ থেকে বিদেশিদের পাঠানো শুরু হয় এক সময়। ‘যখন বিদেশ থেকে লোক আসা শুরু করল, তখন গ্রামের লোক এটাকে বিশ্ব ইজতেমা বলা শুরু করল। শুরার একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, জনগণের চাহিদার ওপর আল্লাহতায়ালা বিশ্ব ইজতেমা করে দিয়েছেন। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নাম নিয়ে তাবলিগ জামাতের মধ্যেই শুরুতে বিতর্ক ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমা নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমার স্থান নির্ধারণের কারণ : ইজতেমার ধারণা শুরু হয়েছিল ভারতে। ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ইজতেমা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশে না হয়ে বাংলাদেশেই স্থায়ী হয়েছে। এর একটা কারণ ছিল, সে সময়ে বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া সহজ ছিল। ইজতেমার নামে কেউ ভিসা আবেদন করলে ফেরত যেত না।
এটা সরকারের একটা ভালো পলিসি ছিল। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এ ইজতেমাকে সমর্থন করেছেন। তা ছাড়া অনেকে মনে করেন, বিশেষ দুটো কারণে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে হয়েছে। তার একটি হলো, বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ; আরেকটি তাবলিগ জামাতের যে আন্দোলন, তা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রীক। যদিও ভারতে এর শুরু, কিন্তু ভারত মুসলিমপ্রধান দেশ না হওয়ায় অনেক দেশের মুসলিমরা সে দেশে যেতে কমফোর্ট অনুভব করেননি। আবার পাকিস্তানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। তাই তাবলিগের জমায়েত বাংলাদেশে শুরু থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যতটা পেয়েছে, ততটা ভারত বা অন্য কোথাও পায়নি। এ ছাড়া সবচেয়ে কম খরচে মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারত। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হওয়ার পেছনে কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভারতের কিছু স্থানে তখনও মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ ছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল, যাকে একটা নিরাপদ পরিবেশ বলে মনে করেছিলেন তারা। এ ছাড়া তাবলিগের এক সম্মেলনে ইজতেমার স্থান হিসেবে লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। অবশ্য এ তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক নিরপেক্ষ একটা স্থান ছিল। রাজনৈতিক কারণে তখন ভারতের নাগরিকরা যেমন সহজে পাকিস্তানে যেতে পারতেন না, তেমনি পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভারতে যাওয়া কঠিন ছিল। ফলে বাংলাদেশই ছিল ওই দেশ, যেখানে সহজে সবাই আসা-যাওয়া করতে পারতেন বলে গবেষকরা মনে করেন। তবে তাবলিগের ইজতেমা যে বিশ্বের অন্য কোথাও হচ্ছে না, তা নয়। পাকিস্তানের রায়বন্ড ও ভারতের ভূপালে বড় আকারে ইজতেমা হয় বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমার ঠিক আগে ও পরে। তবে যে সংখ্যায় বিদেশিরা বাংলাদেশের ইজতেমায় আসেন, তাতে করে তুরাগ তীরের ইজতেমাই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।