বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিদ্বেষ কেন
সৈয়দ শামছুল হুদা
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সারা দুনিয়ায় সংকটের শেষ নেই। প্রকৃতির প্রতি মানুষের অবিচার, সীমাহীন পরিবেশ দূষণ, উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, জলোচ্ছ্বাস, অতি বৃষ্টি ইত্যাদি তো আছেই, পাশাপাশি মানবসৃষ্ট সমস্যা মানুষকে আরো বেশি কষ্টে ফেলছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংঘাত, ধর্মীয় সংঘাত তৈরি করছে। ছোট রাষ্ট্রগুলোকে বড় দেশগুলো নানা উস্কানিমূলক ফাঁদে ফেলে সর্বশান্ত করছে। ভাষা-সংস্কৃতির সমস্যা তো আছেই। রয়েছে নানা বর্ণের আধিপত্যবাদি লড়াইও। উপরন্তু প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এ রীতি চলে আসছে, জোর যার মুল্লুক তার; ক্ষমতা যার, আইন তার; বিত্ত যার, বিচার তার। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, আমাদের আদিম চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
আজ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, পাশাপাশি এ দুটি দেশের উদ্বৃত্ত খাদ্য, যেখানে বিশ্বের অসংখ্য দেশের মানুষের ক্ষুধা মেটাতে কাজ করত। সে ক্ষেত্রেও চলছে চরম অরাজকতা। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি গরিব মানুষকে আরো বেশি গরিবে পরিণত করছে। বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে এমনিতেই চরম খাদ্য সংকট; এর ওপর এসব যুদ্ধ শক্তিশালী দেশগুলোর অর্থনৈতিক কিছু ক্ষতি করলেও গরিব দেশের মানুষকে কঙ্কালসারে পরিণত করছে। ইউনাইটেড ন্যাশন তথা জাতিসংঘও এসব সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নিজেরা অপরাধীদের সহযোগী হিসেবে প্রমাণ করছে। এসবের পাশাপাশি সারাবিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে এক ধরনের ধর্মীয় উস্কানি সব সময় লেগেই আছে।
সম্প্রতি সুইডেনে পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ইরাকি বংশোদ্ভুত একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী যেভাবে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনকে অবমাননা করেছে, আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে তা দেখেছে, এটা গোটা আধুনিক বিশ্বের জন্য চরম পর্যায়ের লজ্জাজনক ঘটনা। এর দ্বারা কী হয়েছে? ওই খ্রিষ্টানের হয়তো সামান্য জাগতিক ফায়দা হবে, কিন্তু ইসলামের কী ক্ষতি হবে? এতে করে কি সুইডেনের রাষ্ট্রীয় সম্মান বেড়েছে? লাভ হয়েছে এতটুকু যে, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের কলিজায় আঘাত করা হয়েছে। মুসলমানরা যেখানে জীবনের চেয়েও পবিত্র কোরআনকে বেশি ভালোবাসে, সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, মান্য করে, সেখানে একজন ব্যক্তি এর ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সে পবিত্র কোরআনের কী ক্ষতি করতে পেরেছে? দুনিয়ায় লাখ লাখ হাফেজে কোরআন রয়েছেন। যারা কোরআনের প্রতিটি হরফ, নোকতাসহ মুখস্থ করে রেখেছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি চাইলেই পবিত্র কোরআনকে ধ্বংস করতে পারবে না। জগৎ থেকে তাকে মুছে দিতে পারবে না। সেই গ্যারান্টি পবিত্র কোরআনেই রয়েছে। কোরআনকে মুছে ফেলার ক্ষমতা দুনিয়ার কোনো শক্তির নেই। তাহলে এমন হিংস্রতা ও সহিসংতা কেন?
কিছুদিন পরপরই ফ্রান্সসহ কিছু ইউরোপীয় দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ পোড়ানো হয়। রাসুল (সা.)-এর নামে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা হয়। এগুলো আবার জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশও করা হয়। এরা মূলত ক্রুসেডীয় উন্মাদনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারছে না। তারা মুসলিম দেশগুলোর দূতাবাসের সামনে এসে নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে এসব উস্কানিমূলক কাজ করে। এরা মুসলমানদের কলিজায় আঘাত করতে চায়। দেখতে চায়, মুসলমানরা এর প্রতিক্রিয়ায় কী করে? মুসলমানরা যখনই প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন এটাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে চায়, মুসলমানরাই উগ্র, জঙ্গি, মৌলবাদি ইত্যাদি। বিপরীতে একজন সুইডিশ মুসলিম ইরাকি খ্র্রিষ্টানের মতো সেও আদালত থেকে বাইবেল এবং তাওরাত পোড়ানোর অনুমোদন নেয়। এরপর একটি মসজিদের সামনে এসে এক হাতে বাইবেল ও তাওরাত, অপর হাতে দিয়াশলাই নিয়ে উপস্থিত হয়। এতেই খ্রিষ্টজগৎ চেচিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই মুসলিম লোকটি দুনিয়ার মিডিয়ার সামনে জানায়, ইসলাম আমাকে অন্য ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থকে পোড়ানোর অনুমতি দেয় না। এটা আমার শিক্ষা না। হোক সেটা ভুলে ভরা, তবু যেহেতু এ কিতাবকে অসংখ্য মানুষ সম্মান করে, সেহেতু তাদের অন্তরে আঘাত দেয়া কোনো মুসলিমের নীতি নয়।
বর্তমান বিশ্বে ভারতও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে অগ্রগামী। বিশেষ করে, একটি কট্টর, উগ্রবাদী সংগঠন আরএসএস দ্বারা পরিচালিত বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। মুসলিম মেয়েদের বোরকা ও হিজাব নিয়ে খেল-তামাশা করা হচ্ছে। কর্ণাটকের ‘মুসকান’ নামীয় একজন মুসলিম নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেই কলেজেরই অন্য শিক্ষার্থীরা যে আচরণ করেছে, তা নজিরবিহীন। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের উগ্রবাদিতার দ্বারা শুধু মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা নয়; বরং অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের ইজ্জত-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাও দায় হয়ে পড়েছে। মণিপুরের কুকি সম্প্রদায়ের দুই তরুণীকে যেভাবে প্রকাশ্যে উলঙ্গ করে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে, তা নারীজাতির ইতিহাসে এক ন্যাক্করজনক বর্বরতার নতুন নজির তৈরি করেছে। ভারতের উত্তর প্রদেশে গরুর গোশত রাখার মিথ্যা অভিযোগে মুসলমানদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে।
এই যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় বিদ্বেষ লালন ও বিকাশের মতো জঘন্য ঘটনাগুলো প্রতিদিন ঘটছে, সেগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা লক্ষ্যণীয়। উপরন্তু তাদের আশকারাতেই যেন তারা আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠছে। চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর চালিত জুলুমণ্ডনির্যাতন নিয়ে কথা বলতে খোদ মুসলিম বিশ্বই ভীত। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় জুলুমণ্ডনিপীড়নের মাত্রা মানুষের কল্পনাশক্তিকেও হার মানিয়েছে। কাশ্মীরি মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের সব ধরনের মানবিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। স্বদেশেই তাদের পরদেশী বানিয়ে রাখা হয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলিমদের অধিকার যেভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে, তার কোনো উপমা নেই। নিজেদের বাড়িঘর থেকে তাদের উচ্ছেদ করে সেখানে ধর্মীয় দোহাই দিয়ে ইহুদিবাদী শক্তিগুলো আসন গেড়ে বসে আছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদিবাদী জায়নিষ্ট গোষ্ঠীর আস্ফালন, বাড়াবাড়ি, নির্যাতন দেখলে সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যাবে। ইউরোপের বুকে ক্ষুদ্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র কসেভো, সেখানেও সার্বিয়রা ধর্মের নামে দোহাই দিয়ে মুসলমানদের ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতন করছে। যদিও সেখানে সম্প্রতি তুর্কী সেনারা পৌঁছেছে।
বিপরীতে মুসলমানরা যখন সত্যিকারার্থেই স্বাধীন ছিল, তখন তারা অমুসলিমদের সঙ্গে সব সময় সম্মানজনক আচরণ করেছে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা খারাপ আচরণ করলে কখনোই তারা এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারত না। ওসমানি খেলাফত ও ভারতবর্ষে মোঘলদের তত্ত্বাবধানে অমুসলিমরা যে মর্যাদা ও সম্মান লাভ করেছে, ইতিহাসে তা বিরল। মুসলমানদের সঙ্গে বর্তমান ইউরোপিয়ানদের অমূলক বিদ্বেষ, ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী শক্তির আক্রোশ, ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর লজ্জাস্কর আচরণ, আরাকানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভ্যাকধারী লোকদের অত্যাচার- এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো? মুসলমানরা ক্ষমতায় থাকলে, সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারে; কিন্তু অমুসলিমরা তাদের দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে না। তারা এটা করতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্যই মুসলমানদের আবার ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসতে হবে। বিশ্ব ক্ষমতায় যে ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজমান, তা থেকে উত্তরণের জন্য মুসলমানদেরই কাজ করতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি, জাতীয় লেখক পরিষদ, ঢাকা