গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ভবিষ্যৎ
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে যত বিশ্লেষণ দেখা যাচ্ছে, এর কোনোটিই ঠিক পুরো গল্প বলছে না। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে আসলে কী ঘটছে, সেটা বের করাও কঠিন। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের নতুন চেহারা এখনও ফুটে ওঠেনি। এখনও ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা, সেটাও এখন পর্যন্ত খুবই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতা এর মধ্যেই কোথাও আছে, কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে হবে, সেসব নির্ভর করছে এ বছর ও পরবর্তীতে যুদ্ধটা কোনদিকে যায়, তার ওপর। এখানে কিছু জিনিস রয়েছে, যা আমরা জানি এবং কিছু আছে, যা জানা নেই। ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণের সময় কিছু লোক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ডকে ব্যঙ্গ করেছিল। কারণ, তিনি সেখানে অজানার কথা বলেছিলেন। পৃথিবীর এ অংশে সেগুলো খুব ভালোভাবেই আছে।
সাধারণ ইসরায়েলিদের ক্ষোভের কারণ : বলা হয়, গাজায় হামাস ও তার অনুজ সঙ্গীকে নির্মূল করার জন্য যে সামরিক অভিযান চলছে, তাতে সাধারণ ইসরায়েলিদের সমর্থন আছে। তাদের ক্ষোভের পেছনে কারণ হলো, হামাসের অকস্মাৎ এক নজিরবিহীন হামলা; যা কেড়ে নেয় ১৪০০ মানুষের প্রাণ। একই সঙ্গে হামাস আরও ২৪০ জনকে বন্দি করে নিয়ে যায় গাজায়। ইসরায়েলের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নোয়াম তিবন এ কথা দাবি করে বলেন, ‘কোনো জাতিই মেনে নেবে না, তার প্রতিবেশি এসে তাদের শিশু, নারী ও মানুষদের হত্যা করবে। যেভাবে ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুদের খতম করেছিল, ঠিক সেটাই আমাদের এখন গাজায় করতে হবে। ক্ষমার সুযোগ নেই।’ কিন্তু যেসব নিরীহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছে, তাদের কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত এটা ঘটছে। আমরা কঠিন প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকি। আর টিকে থাকতে হলে আমাদেরও কঠোর হতে হবে।’ তিনি ছাড়া আরো অনেক ইসরায়েলি এ ভাবনা পোষণ করেন, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক।
ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যায় গরমিল : গাজায় হামাসের ওপর ইসরায়েলের হামলা ভয়াবহ রক্তপাত ঘটাচ্ছে। হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু। এটা পরিষ্কার নয় যে, যেসব মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে কতজন বেসামরিক নাগরিক আর কতজন হামাস বা ইসলামি যোদ্ধা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলিরাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ হিসাব বিশ্বাস করে না। কিন্তু অতীতের সংঘাতগুলোতে ফিলিস্তিনি হতাহতের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, সেটা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারা নির্ভুল বলে গণ্য হয়। একটা মাইলস্টোন এখন চোখের সামনে। জাতিসংঘের হিসেবে ২ বছর আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় ৯৭০০ জন বেসামরিক নাগরিক সেখানে মারা গেছে।
বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে জাতিসংঘের তথ্য : ফিলিস্তিনিদের কিছু মৃত্যুর মধ্যে হয়তো হামাসও আছে। কিন্তু সেটা যদি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশও হয়, যেটার সম্ভাবনা খুবই কম, তারপরও দেখা যায়, রাশিয়া ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যতজনকে হত্যা করছে, ইসরায়েলিরা তার চেয়েও বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে গাজায় তার সাম্প্রতিক আগ্রাসনে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেনের এ হিসাবটা অসম্পূর্ণ। বেসামরিক নাগরিক মৃত্যুর সংখ্যা আরেকটু বেশি হবে। এদিকে গাজার মৃতের সংখ্যাও দ্বিগুণ হবে। কারণ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বলছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় এত বেশি পরিমাণ বেসামরিক নাগরিক মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে যে, এ হামলাগুলো খুবই বিশৃঙ্খলভাবে করা হচ্ছে; যা যুদ্ধপরাধের শামিল।
যুদ্ধে নেতানিয়াহুর জড়ানো অনুচিত : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভীষণ চাপে আছেন। যদিও তিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর প্রধানদের মতো গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল সীমান্তে যে মারাত্মক নিরাপত্তা বিপর্যয় ঘটেছে, এর কোনো ব্যক্তিগত দায়ভার স্বীকার করেননি। গত ২৯ অক্টোবর তার একটা টুইট আলোচনার ঝড় তোলে। যেখানে তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করেন। তবে পরে মি. নেতানিয়াহু টুইটটি মুছে দেন ও ক্ষমা চান। তিনজন ইসরায়েলি, যাদের একজন সাবেক শান্তি মধ্যস্থতাকারী, আরেকজন শিন বেতের (ইসরায়েলের ঘরোয়া নিরাপত্তা সংস্থা) সাবেক প্রধান এবং একজন প্রযুক্তি ব্যবসায়ী; তারা ফরেন অ্যাফেয়ার্সে জার্নালে একটা নিবন্ধ লেখেন। যেখানে তারা বলেন, এ যুদ্ধ ও আগামীর দিনগুলোতে মি. নেতানিয়াহুর কোনোভাবেই জড়িত থাকা উচিত হবে না।
প্রাচীনপদ্ধতি বিভাজন ও শাসন : ২০০৫ সালের দিকে শেষ ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সমাপ্তির পরে একটা কাঠামো তৈরি হয়; যেটা মি. নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য টিকিয়ে রাখা যাবে। যুক্তি ছিল, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের জন্য আর হুমকি নয়। বরং তারা এমন একটা সমস্যা, যেটার সমাধান আছে। এ জন্য বেছে নেওয়া হয় প্রাচীনপদ্ধতি বিভাজন ও শাসন এবং একই সঙ্গে প্রয়োজনে কঠোর ও নমনীয়। মি. নেতানিয়াহু যিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সালে একবার ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০০৯ সালের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায়; তিনি সব সময় বলে এসেছেন, শান্তির জন্য ইসরায়েলের কোনো অংশীদার নেই। কিন্তু সম্ভবত ছিল। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ), যারা হামাসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী; এর অনেক সমর্থকই মনে করেন, তাদের বয়স হয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের এখন সরে দাঁড়ানো উচিত। তবে তারা ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাটা ১৯৯০-এর দশকে গ্রহণ করে।
রক্তপাত হতে যাচ্ছে আরো : যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে থাকা ইসরায়েল কোনো যুক্তি বা চুক্তিই মানতে রাজি নয়, ইসাঈল ফিলিস্তিনিরা একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং তাদের একটি রাষ্ট্র থাকা উচিত এ কথাও মানতে রাজি নয়। এ জন্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে সে নির্মূূূূূূল করতে চায়। আরব আর ইহুদিদের মধ্যে জর্দান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মাঝের জমি নিয়ে বিরোধ ১০০ বছরের বেশি টিকেছিল। এ দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাস বলে দেয়, সামরিক পথে কোনো সমাধান আসবে না। নব্বইয়ের দশকে ইসরায়েলের পাশাপাশি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে এ সংকট সমাধানের চেষ্টায় অসলো শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল; যা বাস্তবায়নে সর্বশেষ চেষ্টা দেখা গেল ওবামা প্রশাসনের সময়। বছরের পর বছর বৈঠক-আলোচনা চলল। কিন্তু এক দশক আগেই সেটা ব্যর্থ হয়েছে, আর তারপর থেকে এ সংঘাত ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র না হলে প্রজন্মতর যুদ্ধের শঙ্কা : প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন, আরো বেশি যুদ্ধ এড়ানোর একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হলো, ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু উভয় দিকে এখন যে নেতৃত্ব আছে, তাদের দ্বারা এটা সম্ভব নয়। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দিকের চরমপন্থিরা এ ধারণা ঠেকাতে যা করার করবেন। যেমনটা তারা ১৯৯০-এর পর থেকে করে আসছেন। কিন্তু এ যুদ্ধ যদি এখন তাদের চিন্তা-ভাবনায় ধাক্কা না দেয় এবং দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আরও অবশ্যম্ভাবী করে না তোলে, তাহলে আর কিছুতেই সেটা সম্ভব হবে না। আর দুই পক্ষের বোঝাপড়ার মাধ্যমে এ সংঘাতের অবসান না হলে, দুই দিকের আরও অনেক প্রজন্ম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে। ইসরাঈল এরই মধ্যে বিশ্বসমাজে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নিষ্ঠুর মানবতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ইসরাঈল হয়ত মনে করেছে গায়ের জোরে সে সবকিছু করবে এবং আমেরিকার সমর্থনে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহর মার দুনিয়ার বার। যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না তারাও বলে থাকে ন্যাচারাল পানিশমেন্ট। প্রাকৃতিক শাস্তি। সেই শাস্তি ইসরাঈলের জন্য অপেক্ষা করছে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও প্রাবন্ধিক