ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এরদোয়ান বিশ্ব রাজনীতির দক্ষ খেলোয়াড়

সৈয়দ শামছুল হুদা
এরদোয়ান বিশ্ব রাজনীতির দক্ষ খেলোয়াড়

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম রাজনৈতিক খেলোয়াড়, মুসলিম বিশ্বের দরদি নেতা রজব তাইয়েব এরদোয়ানের কৌশলী রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ার সমর্থকসহ বিশ্বের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা ভালো বিপদে পড়েছেন। এইতো ক’দিন আগেই তাকে বিজয়ী হিসেবে দেখতে রাত জেগে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় তুলেছিলেন; বিশেষভাবে তার বঙ্গ সমর্থকরা। সেই এরদোয়ানই কিনা ?মুসলমানদের কলিজায় আঘাত দানকারী সুইডেনকে সমর্থন করে ন্যাটোতে যোগদানের সুযোগ করে দিলেন? সামান্য ?দুনিয়ার স্বার্থে এত বড় পদস্খলন? এত দোয়া, সমর্থন এখন কীভাবে প্রত্যাহার করবে তারা? তাদের বক্তব্য হলো, এরদোয়ানকে যতই আমরা মুসলিম বিশ্বের সুলতান মনে করি না কেন, যতই আমরা তাকে আপন মনে করি না কেন, মূলত তার দ্বারা মুসলমানদের কোনো স্বার্থই রক্ষা হবে না। কারণ, তিনি একজন গণতন্ত্রপ্রেমী। আর গণতন্ত্রপ্রেমীদের দিয়ে ইসলামের কোনো উপকার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এদের তুলনায় তালেবানের মেরুদণ্ড কত শক্ত! তারা সুইডেনের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। এতটুকু করার সাহসও এরদোয়ানের নেই।

পাশাপাশি এ আলোচনাও হচ্ছে, এরদোয়ান রাশিয়ার সঙ্গে বেঈমানি করেছে। জেলেনস্কির ৫ জন কমান্ডোকে রাশিয়ার সঙ্গে কৃত শর্ত লংঘন করে ফেরত পাঠিয়েছে। এ বেঈমানির খেসারতও এরদোয়ানকে দিতে হবে। এভাবে একের পর এক অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে। এর ওপর রয়েছে তুরস্কে থাকা কিছু ভাইদের নানা বিশ্লেষণ। আমরা এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সুতরাং এরদোয়ানকে আর কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। মুসলমানদের আবেগ নিয়ে তিনি খেলা করছেন। মাঝেমধ্যে ইসলামের কথা বললেও মূলত তিনি ইসলামের প্রকৃত সেবক নন।

ওপরের কথাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো এক ধরনের বাস্তবতা। অনেক ভাই এরদোয়ানকে নিয়ে চরম বিপদে রয়েছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এ সময়ে এরদোয়ান যে অসাধারণ রাজনৈতিক ক্যারিশমা দেখিয়ে যাচ্ছন, যেভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে গুটি চালাচালি করছেন, যেভাবে রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে দূতিয়ালি করে যাচ্ছেন, তাতে করে প্রমাণিত হয় যে, এরদোয়ানের কূটনীতি বোঝা এত সহজ নয়। সুইডেন ন্যাটোকে স্বাগত জানানো হয়েছে বটে, তবে এর পেছনে তিনি এতদিন যে খেলা খেলেছেন, তা নিকট অতীতে কোনো মুসলিম দেশের পক্ষে করাও সম্ভব ছিল না। সুইডেনকে স্বাগত জানিয়েছেন এ শর্তে যে, তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও জায়গা করে দিতে হবে। তুরস্ক যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারে, তাহলে তুরস্ক হয়ে গোটা ইউরোপে মুসলমানদের যাতায়াতের পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে এরদোয়ান সঠিক পথেই রয়েছেন বলে মনে করা হয়। যারা রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে না, সুযোগ পেলেই এরদোয়ানের ব্যাপারে মনের সুপ্ত বিদ্বেষটা উগ্রে দেয়, তারা মূলত এরদোয়ানের রাজনীতিকে অন্যদের রাজনীতির মাপকাঠিতে মাপতে চায়। এরদোয়ানকে তুরস্কের রাজনীতির মাপকাঠিতে মাপতে হবে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলিত রাজনীতির মাপকাঠিতে মাপতে হবে। তালেবানের রাজনীতি আর এরদোয়ানের রাজনীতির গতিপথ এক পাল্লায় মাপলে ভুল করা হবে। তুরস্কের রাজনীতি আর আফগানের রাজনীতি এক সরল রেখায় চলে না। এরদোয়ানের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক অভিলাষ সম্পর্কে পাশ্চাত্য শঙ্কিত হলেও আমরা তাকে অবমূল্যায়ন করতে সামান্য দেরি করি না।

এরদোয়ান সুইডেনকে নাকানি চুবানি খাইয়ে তারপরই গ্রীন সিগনাল দিয়েছেন।

এরপর বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে তুরস্ককে রক্ষা করেই এমন শর্তে সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছেন, যেগুলো পাশ্চাত্যের পক্ষে মেনে নেয়া আরো কষ্টের। আজকে যদি এরদোয়ান এককভাবে সুইডেনকে নিয়ে গো ধরে বসে থাকতেন, তাহলে কাছে ভবিষ্যতে তুরস্কের পথে বাঁধার পাহাড় তৈরি করত পাশ্চাত্য। এখন তাদের পক্ষে কিছু করা কঠিন। তারা গোটা ইউরোপকে তুরস্কের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলত। তারা নানা সেক্টরে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠত।

এতে তুরস্কের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য, তা বাঁধাগ্রস্ত হতো; বরং সুইডেনকে অনেক অনুরোধের পর অনুমতি দিয়ে তুরস্ক বড় ধরনের দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। তুরস্ক এর মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছে বড় ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থ। দর কষাকষির যে চরম শিখরে এরদোয়ান পৌঁছাতে পেরেছেন, তা তুরস্ককে আরো অনেক বেশি উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এরদোয়ান গো ধরে বসে থাকলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তার আফ্রিকান রাজনীতিতে, ইউরোপীয় কসভো নীতিতে। ইউরোপের ?বুকে এক ঘরে করে ফেলতে পারত তুরস্ককে। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়।

এরদোয়ান গো ধরার রাজনীতি করেন না। ড. মুরসির খুনি সিসি’র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বৃহত্তর স্বার্থে। মধ্যপ্রাচ্যের ইভিলচক্র আরব-আমিরাতের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। সাংবাদিক খাশোগির হত্যাকারী সৌদির সঙ্গে সাপে-নেউলের সম্পর্ক থেকেও বেরিয়ে এসেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যাতে একবার তাকে রাজনৈতিক কষাঘাত মারলেও পরক্ষণেই আবার কোলে তুলে নিচ্ছে। একদিকে জেলেনস্কির হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন তো আবার পুতিনের সঙ্গেও কোলাকুলি করছেন। এটাই রাজনীতি। বিশ্বমোড়লীপনা না শিখলে তো বিশ্বে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা যাবে না। এ জন্যই বলা হয়, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই। বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় এ মুহূর্তে এরদোয়ান। তার রাজনীতি আর তালেবানের রাজনীতির তুলনা করা ভুল। আমরা হুজুগে বাঙালি খুব সহজেই প্রত্যাখ্যানের রাজনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। এরদোয়ান তো অনেক পরের বিষয়, বিশ্ববরেণ্য আলেম তাকি উসমানির ওপরও দেখি বাঙালি সমর্থকরা মাঝে মধেই হামলে পড়ে। একদিকে তাকে জগতের শ্রেষ্ঠ আলেম মনে করা হয়, আবার পরক্ষণেই মতের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য হলেই তাকেও আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করছে না। এরদোয়ানের সফলতা হলো, তিনি দুনিয়ার সব পরাশক্তির চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। কখনও ছাড় দেন, কখনও কাউকে ছুঁড়ে মারেন। প্রয়োজনে কাছে টানেন, বাড়াবাড়ি করলে দূরে ঠেলে দেন। এরদোয়ানের রাজনীতি বোঝার জন্য সময়ের প্রয়োজন। তার গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করা উচিত। হুট করেই তাকে ইসলামের সীমার বাইরে ফেলে দেয়ার মানসিকতা আর যাই হোক মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকর নয়।তুরস্কের ইসলামাইজেশনে এরদোয়ানের দূরদর্শী অবদান অন্তত তুর্কি জাতি ভুলতে পারবে না। পাশ্চাত্যকে তাদের ক্রোধের আগুনে পোড়াতে এরদোয়ানের বিকল্প এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকায় তুরস্কের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। বাকু থেকে কসভো, সোমালিয়া থেকে আরাকান সর্বত্রই এরদোয়ানের নাম উচ্চারিত হয়। বীর তুর্কি জাতির উত্থানে মুসলিম বিশ্বে আশার আলো সঞ্চারিত হচ্ছে। চলতি বছর নির্বাচনের পর তার নবগঠিত মন্ত্রিসভা দেখে অবাক হয়নি, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছে। অচিরেই নতুন এক তুর্কিকে দেখতে পাবে বিশ্ব। এরদোয়ান এর শুভসূচনা করে গেলেন।

লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি, জাতীয় লেখক পরিষদ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত