ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইন্দোনেশিয়ার রমজান সংস্কৃতি

মনুষ্য বসতির ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো দেশ ইন্দোনেশিয়া। তিনশ’র বেশি জাতি-গোত্র আর সাড়ে সাতশ’র মতো ভাষা রয়েছে দেশটিতে। এখানে রয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। আরবীয়, ভারতীয়, চীনা, মালয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে জীবনাচারে। ১৭ হাজার ৫০৮টি দ্বীপের সমষ্টি দেশটির জনসংখ্যা ২৫ কোটি ৫৪ লাখ ছাড়িয়ে। জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ ভাগ মুসলমান। সেখানে রমজান কীভাবে পালিত হয়, তা নিয়ে লিখেছেন - মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ইন্দোনেশিয়ার রমজান সংস্কৃতি

মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। সেখানে রমজান শুরু হয় উৎসবের মধ্য দিয়ে। রহমতের মাসের চাঁদ ওঠার সংবাদ প্রচার হওয়ার পর তাদের মাঝে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের পাশে কোনো খোলা জায়গায় বিশাল ড্রাম বাজিয়ে সবাই পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়। ইন্দোনেশিয়ার মধ্য জাভার সেমারাং শহরের বাসিন্দারা হাজার বছর ধরে ‘দুগদেরান’ নামের এক উৎসব পালন করে থাকেন। রমজান মাস শুরুর সংকেত হিসেবে প্রতি বছরই দেশটির মসজিদগুলোতে ঢাক পেটানো হয়। ‘দুগ’ শব্দটি এসেছে মসজিদের ওই ঢাকের শব্দ থেকে। এর পাশাপাশি মসজিদের কামান থেকে গোলাবারুদ ছোঁড়া হয়। ‘দার’ শব্দটি এসেছে কামানের ওই আওয়াজ থেকে। সাধারণত রমজান শুরুর দুই সপ্তাহ আগ থেকে সেমারাং শহরের বাসিন্দারা এ উৎসব পালন করে থাকেন। উৎসবে বাসিন্দারা রং-বেরঙের পোশাক পরেন, শোভাযাত্রায় অংশ নেন।

মিউগানা ও মুংগাহান : অন্যদিকে পশু জবাই করার মধ্য দিয়ে পালিত হয় ‘মিউগানা’। এর আরেকটি নাম ‘মাকমিউগানা’। রমজান শুরুর দিন দুয়েক আগে পালন করা হয় এ রীতি। রমজান মাস শুরুর একদিন আগে সুদানিসির নৃগোষ্ঠী পালন করে থাকে ‘মুংগাহান’। মুংগাহানের উৎপত্তি ‘উনগাহ’ শব্দ থেকে। যার অর্থ সামনের দিকে এগিয়ে চলা। রোজাদার যেন আগের বারের চেয়ে আরও বেশি সংযমের সঙ্গে এবারের রোজা পালন করতে পারে, এ উদ্দেশেই ‘মুংগাহান’ উৎসব পালন করা হয়। বিভিন্নভাবে ‘মুংগাহান’ পালন করা হয়। যেমন- পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করা। অর্থাৎ এমন কিছু করা, যেখানে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়।

সাঁতার কেটে পাদুসান : ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে ‘শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ’ করার একটি রীতি প্রচলিত আছে। রমজান শুরুর আগে তা করা হয় নদী, পুকুর বা সমুদ্রে গোসল ও সাঁতার কাটার মাধ্যমে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এ বিশ্বাস থেকেই ইন্দোনেশিয়ার ক্লাটেন, বোয়োলাটি, সালাতিগা ও ইয়োগিয়াকার্তার বাসিন্দারা ‘পাদুসান’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন।

সম্মিলিত প্রার্থনা ও কলাপাতায় খাবার : আগে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা ও বুজুর্গরা পবিত্র ঝরনা নির্ধারণ করে দিতেন। অন্যরা সেখানে গিয়ে নিজেদের বিশুদ্ধ করে নিতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই সুইমিংপুল, নিকটস্থ পুকুর বা বাড়িতেই নিজেদের পবিত্র করে নেন। স্থানীয়রা সারাং পরে সম্মিলিতভাবে শোভাযাত্রা করে নিকটস্থ নদী, ঝরনা বা সমুদ্রে যান। এ সময় তাদের হাতে থাকে খাদ্যপূর্ণ ঝুড়ি। তারা বিশ্বাস করেন, ঝরনার পানি আসে ধরিত্রী মাতার উদর থেকে। তাই এ পানি খুব পবিত্র। তারা মুখে ও বাহুতে পানি ছিটিয়ে নিজেদের পরিষ্কার করে গোসল সম্পন্ন করেন। এরপর যোগ দেন সম্মিলিত প্রার্থনায়। প্রার্থনা শেষে বয়ে আনা খাবার কলাপাতার ওপর সাজানো হয়। সবাই মিলে তা গ্রহণ করেন।

সাহরি ও ইফতারে কোলাক : ইন্দোনেশিয়ায় ইফতারকে বলা হয় ‘বুকা’। যার অর্থ- শুরু করা। ইফতার আয়োজনে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো, ‘আবহাম’ নামের পানীয় এবং খেজুর। খেজুরের সঙ্গে ‘কোলাক’ নামে এক প্রকার মিষ্টান্নও পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া তারা রাতের খাবারে ভাত, সবজি, মুরগি ও গরুর গোশত খেতে পছন্দ করে। তবে সাহরিতে খাবার খায় খুবই সামান্য।

সুরাবায়ায় রমজানের শুরুতে আপেম : দেশটির সুরাবায়া শহরে রমজানের শুরুতে ‘আপেম’ নামীয় একটি খাবার না হলে চলেই না। রমজানে তাদের প্রতিদিনকার খাবার এটি। তবে খাবারের চেয়ে এর উদ্দেশ্যটা বেশি চমৎকার। ধারণা করা হয়, আপেমের উদ্ভব আরবি ‘আফওয়ান’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘দুঃখিত’। খাবারটিকে ‘ক্ষমা’র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তাই পরিবার-পরিজন সবাই একসঙ্গে ‘আপেম’ খাওয়ার পর একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগের সব ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চান। ‘আপেম’ দেখতে চিতই পিঠার মতো। নারকেল ও চালের গুড়া দিয়ে এই স্ন্যাকসটি তৈরি করা হয়।

জাকার্তায় নিওরোজ উৎসব : ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ‘নিওরোজ’ নামের উৎসবটি পালন করা হয়। ‘নিওরোজ’ শব্দের অর্থ- পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করা। তাই রমজানের আগে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে বাবা-মা, দাদা-দাদি, শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ অন্যান্য স্বজনদের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পাঠানোর মাধ্যমে ‘নিওরোজ’ পালিত হয়। সাধারণত এর তালিকায় থাকে গোশত, কফি, দুধ, চিনি, মিষ্টি রসসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য।

নারীরাও তারাবির জামাতে অংশ নেন : ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা যথেষ্ট ধর্মপরায়ণ। তারা ধর্মীয় জীবনযাপন এবং সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। রমজানে তাদের ধর্মীয় এ স্পৃহা আরও বেড়ে যায়। পুরুষের মতো নারীরাও মসজিদে তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়।

রাতব্যাপী কোরআন পাঠের ঐতিহ্য : পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের মুসলিমরা রমজান মাস উদযাপন করেন। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার বন্টেন প্রদেশে রমজানে কোরআন পাঠের সংস্কৃতি একটু ভিন্নতর। এ প্রদেশের মুসলিমরা নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে তারাবির পর থেকে সাহরি পর্যন্ত অবিরত কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের পশ্চিমাঞ্চলীয় অধিকাংশ প্রদেশে ‘মিকরান’ নামের কোরআন পাঠের এ ঐতিহ্য অদ্যাবধি চালু রয়েছে।

সাহরিতে সময়ের সমাপ্তি অনুমান : পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের এ ঐতিহ্য বন্টেন সালতানাতের প্রাদেশিক রাজধানী সেরাংয়ে প্রথমে শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বন্টেন সালতানাতের দ্বিতীয় শাসক সুলতান মাওলানা হাসানুদ্দিনের বংশধর আহমদ ফয়সাল আব্বাস এক বিবৃতিতে জানান, ‘প্রাচীনকালে মসজিদে শব্দ করে কোরআন তেলাওয়াত করে সাহরির সময়ের সমাপ্তি অনুমান করা হতো।’

যোগ্যতা ও দক্ষতা তুলে ধরা : রমজানের পুরো রাতে কোরআন তেলাওয়াতের জন্য সব মসজিদে ৮ থেকে ১৬ জনকে নির্বাচন করা হয়। সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াতের মাধ্যমে সবার সামনে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা তুলে ধরার অবারিত সুযোগ পায় তরুণরা। বন্টেন প্রদেশের ধর্ম বিভাগীয় প্রধান লুকমানুল হাকিম বলেন, ‘আধুনিক যুগে মসজিদে যখন মাইক্রোফোনের ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকে কোরআন তেলাওয়াতেও লাউড স্পিকার ব্যবহার করা হতো। যাতে আশপাশের সবাই তেলাওয়াত শুনতে পান।’ মিকরান পদ্ধতিতে তেলাওয়াতের ঐতিহ্য স্থানীয় সব মুসলিমের মধ্যে রমজান মাসে পুরো কোরআন পাঠের অনুপ্রেরণা তৈরি করে। এমনকি অনেকে পুরো মাসে তিন বা চার বার কোরআন পড়ার সুযোগ পান।

তের নম্বর মাসের বোনাস : রমজান মাসে ইবাদত-বন্দেগি ও কল্যাণমূলক কাজে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের প্রতিযোগিতা চোখে পড়ার মতো। বড় বড় শহরে বসবাসকারী মুসলিমরা প্রায়শই রমজানের শেষের দিকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যান। তখন শ্রমিকদের দেওয়া হয় এক মাসের বেতনের সমান বিশেষ বোনাসের টাকা। ইন্দোনেশিয়রা একে ‘তের নম্বর মাসের’ বোনাস বলে থাকেন। ধনী থেকে মধ্যবিত্ত অনেকেই এ মাসে জাকাতের পাশাপাশি বাড়তি দান-খয়রাতের হাত বাড়িয়ে দেন।

অভিবাসীদের জন্য সাহরি-ইফতার : বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মতো ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে আশ্রিত মুসলিম অভিবাসীরাও রোজা রাখেন। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুয়ালালাঙসা শহরের এই শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের শতাধিক নাগরিককে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার পক্ষ থেকে এসব মানুষের জন্য ইফতার ও সাহরির আয়োজন করা হয়।

স্বজনদের কাছে ক্ষমা : ইন্দোনেশিয়রা ঈদুল ফিতরকে ‘লেবারান’ বলে থাকে। রমজানের শেষ সন্ধ্যা আসা মাত্র ঢোল বাজানো, নামাজ আর বয়ানের ভেতর দিয়ে উৎসব শুরু হয়ে যায়। বহু ইন্দোনেশিয় ঈদের নামাজের পর ঘরে ফেরার পথে পড়শি বা বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে যায়। প্রায়ই সংক্ষিপ্ত এসব সফরে তাদের বিরুদ্ধে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপার জড়িত থাকে। সত্যিই আগের বছর আহত বা কষ্ট দেওয়া হয়েছিল, এমন আত্মীয় ও বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাওয়া এ দিনের বৈশিষ্ট্য। ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত লেবারান সম্ভাষণ হচ্ছে ‘সালামাত ঈদুল ফিতরি লাহির বাতিন’। যার অর্থ হচ্ছে ‘শুভ ঈদুল ফিতর, আমাদের সব পাপের জন্য ক্ষমা করো।’ ঈদের দিন বেশির ভাগ ইন্দোনেশিয় বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে দিন শুরু করে। তারপর বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে।

পাসুতে শুরু বালিমায় শেষ : রিয়াও প্রদেশে ঈদ উৎসব পালন করা হয় একটু ভিন্নভাবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে প্রদেশের বাসিন্দারা ঐতিহ্যবাহী নৌকাগুলো নিয়ে নৌকা বাইচের আয়োজন করে। যা ‘জালুর পাসু’ নামে পরিচিত। এ নৌকাবাইচের সময় শত শত মানুষ নদীর দু’পাড়ে ভিড় জমায়। তবে উৎসবটি নৌকাবাইচ দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় ‘বালিমা কাসাই’ দিয়ে। অর্থাৎ নদীতে শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য গোসলের মাধ্যমে। ধারণা করা হয়, এই গোসলের মধ্য দিয়ে তারা আত্মাকে পবিত্র করে নেয়। যেন পরের দিনগুলোতে আরো ভালোভাবে চলতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত