৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে গাজা মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রা.) দখল করেন। অধিকাংশ গাজাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর সমৃদ্ধি ও পতনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডাররা ফাতেমিয়দের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়। পরবর্তীতে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) তাদের বিতাড়িত করেন। ১৩ শতাব্দীর শেষাংশে গাজা মামলুকদের হাতে থাকে। সিনাই উপদ্বীপ থেকে কায়সার পর্যন্ত একটি বিশাল প্রদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়। গাজা ১৯০৩ এবং ১৯১৪ সালে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনী শহর দখল করে। ১৯৩৩ সালে প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হয়। তখন ফিলিস্তিনের বুকে আবির্ভাব হয় এক সিপাহসালার বীর মুজাহিদের। শায়খ ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম। তিনি সুবিন্যস্ত বিপ্লবী জামাত গড়ে তোলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশবিরোধী এক লড়াইয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে দৃশ্যপটে আসেন ফিলিস্তিনি বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ শহিদ আবদুল কাদের হোসাইনি। ১৯৯৬ সালে তিনি অনেকগুলো বিপ্লব সংঘটিত করেন। তার সশস্ত্র বাহিনী শুধু ১৯৩৬ সালে ৫০৬টি কমান্ডো অপারেশন চালায়। ১৯৩৮ সালে ১ বছরে ৫৭৮টি কমান্ডো অপারেশন পরিচালনা করে। ১৯৩৯ সালে ৩ হাজার ৩১৫টি কমান্ড অপারেশন চালায়। সর্বমোট ১০ হাজারের অধিক ব্রিটিশের প্রাণহানি হয়। তবে এজন্য ১২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির রক্তের কোরবানি দিতে হয়। বন্দি হয় ৫০ হাজারের অধিক। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৩৪৫) পর গাজা ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়ে মিশরিয়দের হস্তগত হয়। ১৯৬৭ সালে সংঘটিত হয় আরেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। গাজা পুনঃদখল করে ইসরাইল।
প্রথম ইন্তিফাদা : ইহুদি ইজরাইল মসজিদে আকসাকে নিজেদের ইবাদতগাহ বানানোর অভিলাষে চক্রান্তের জাল বোনে। এ উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ অক্টোবর ইসরাইলি সেনারা মসজিদে আকসায় নামাজরত মসজিদের ওপর গুলি ছোঁড়ে। এতে ২২ জন নিহত ও দু’শতাধিক আহত হয়। এর প্রতিশোধে আমির সৌদ নামক এক ব্যক্তি তিনজন ইসরাইলিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ফুঁসে ওঠে ইসরাইল। শুরু হয় প্রথম ইন্তিফাদা বা গণজাগরণ আন্দোলন। এ আন্দোলন ৬ বছর স্থায়ী হয়। এতে ২৭৭ জন ইহুদি ইসরাইলি নিহত হয়। ১৯৬২ জন ফিলিস্তিনি শাহাদত বরণ করে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। পরে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়। গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যায় প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের হাতে। এ ইন্তিফাদায় এমন কিছু অর্জন হয়, যাতে আপামর জনসাধারণ চরম বিস্মিত হয়। ফিলিস্তিনের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়। জেরুসালেমের একচ্ছত্র অধিকার শুধু মুসলিমের; এ বিশ্বাস আরো বধ্যমূল হয় মানব হৃদয়ে। সব ধরনের সংগঠন আপন মতভেদ ভুলে হাত হাত রাখে। সে বছরের ১৪ ডিসেম্বর হামাস তাদের অফিসিয়াল প্রচারণা চালালে ইজরাইলি গভর্নর হামাসের ১২০ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা : ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। ইসরাইলের বিরোধী দল লিকুদ পার্টির তৎকালীন নেতা অ্যারিয়াল শ্যারন ১ হাজার পুলিশ নিয়ে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে এবং আপত্তিকর বক্তব্য দেয়। এতে ফুঁসে ওঠে বিপ্লবী জনতা। শুরু হয় যুদ্ধ। পাথর থেকে বোমা পর্যন্ত গড়ায় এ যুদ্ধ। এতে ৩৩৯২ জন ফিলিস্তিনি শহীদ ও ৯৯৬ জন ইসরাইলি নিহত হয়। ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মাহমুদ আব্বাস ও শ্যারনের সমঝোতায় এ রক্তপাতের অবসান হয়। গাজা থেকে ব্রিটিশ সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হলে ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। গাজার বেশিরভাগ আসনে নির্বাচিত হয় হামাস। বিরোধী দল ফাতাহের সঙ্গে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। অবশেষে গাজা উপত্যকা থেকে বের করে দেওয়া হয় ফাতাহকে। ২০০৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত ইসরাইল গাজার দিকে আবারো দৃষ্টি ঘুরায়। সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে স্থায়ীভাবে অবরোধ শুরু করে। মিশরও অভিন্ন পথে হাঁটে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গাজাবাসী। বহিঃসংযোগ বি”িছন্ন হয়ে যায়। ১৬ বছর ধরে তারা এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকে। এ কারণেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরন ও মার্কিন অর্থনীতিবিদ নোয়াম চমস্কিসহ অনেকেই গাজা ভূখণ্ডকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার শব্দে ব্যক্ত করেছেন।
গণঅভ্যুত্থানের ইতিবৃত্ত : সামরিক কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই এ দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ছিল গণমানুষের আন্দোলন। কারণ, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এ মর্মে স্বাক্ষরিত হয়, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকতে পারবে না। অতীতের সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলএ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সে সংগঠন ভেঙে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে হামাস নির্বাচনে বিজিত হলে গড়ে তোলে এক্সকিউটিভ কোর্স। পরে হামাস ক্ষমতাচ্যুত হলে বাহিনী ভেঙে যায়। তারপর ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড নামের একটি সংগঠন সামরিক শাখায় দায়িত্ব পালন করে। হামাস মূলত বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক ইসলামি সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের গাজাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত শাখা সংগঠন। ইখওয়ান থেকে হামাসে রূপান্তরিত হয় ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ডজন খানেক মানুষকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করে। এ ধরনের ঘটনা পরবর্তী সময়ে মহামারি আকার ধারণ করে। জরুরি বৈঠকে মিলিত হয় শেখ আহমদ ইয়াসিনসহ প্রসিদ্ধ ও নেতৃস্থানীয় নেতাবৃন্দ। সে আলোচনায় ইখওয়ান পরিচালিত ও সমর্থিত কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের ধর্মঘট পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। আশাতীত সাড়া পড়ে ইখওয়ানের ডাকে রাজপথের এ মিছিলে। এটাই সেই ঐতিহাসিক দিবস, যেদিন ইখওয়ান আজকের হামাসে রূপান্তরিত হয়।