ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামি রাজনীতির ফিলহাল

সৈয়দ শামছুল হুদা
ইসলামি রাজনীতির ফিলহাল

বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতি পথ হারিয়েছে অনেক আগেই। রাজনীতি এখন আর রাজার নীতি নয়। রাজনীতি হয়ে উঠেছে পেশিশক্তির অপব্যবহারের এক মুক্তমঞ্চ। এখানে জাতীয় রাজনীতি যেমন জবাবদিহিতাহীন, তেমনি ইসলামি ধারার রাজনীতিও নানা সমস্যায় প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতি সর্বত্র পরিলক্ষিত। রাজনীতি মানে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। মানুষের সুখ-দুঃখে অংশীদারিত্বের যে আবেদন, তা আজ ম্লান হয়ে গেছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অর্থ-বিত্ত অর্জনের সিঁড়ি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনা বাধায় লুটেপুটে খাওয়ার নামই হয়ে গেছে রাজনীতি। বিশেষ করে, বাংলাদেশে রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তা, সক্ষমতা খুব বেশি প্রয়োজন, সেগুলোকে প্রথমে ধ্বংস করা হয়েছে। সেসব জায়গায় অযোগ্য, অথর্ব লোকদের বসানো হয়েছে। তাদেরও অনৈতিকতায় জড়ানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর সেসব প্রতিষ্ঠান যেসব উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত, তা ভুলে গেছে। তারা অন্যের জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত করবে? দেশের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রশাসন সর্বত্র নৈতিকতা বিবর্জিত একদল লোকের যেন মিলনমেলা। যে কারণে সর্বত্রই এখন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, খামখেয়ালি। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিবিদদের ওপর থেকে দিন দিন আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।

জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ইসলামি ধারার যারা রাজনীতি করেন, তাদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। বিভক্তি, বিরোধ, দায়িত্বহীনতা এখানে আরো ব্যাপক হয়ে উঠেছে। দেশের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতার প্রকট অভাব এখানে বিদ্যমান। জ্ঞানগত দুর্বলতা, দৃষ্টিভঙ্গিগত ভঙ্গুরতা, অসহিষ্ণুতার ব্যধি মারাত্মক আকারে বিদ্যমান। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য লোকের যেমন অভাব, তেমনি আনুগত্যশীল কর্মী বাহিনীরও অভাব। ইসলামি ধারার দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। তারা আসলে কী চায়, এটা নিজেরাও ঠিকমতো জানে না। ইসলামি ধারার নেতৃত্বের আবার রয়েছে নিজস্ব বলয়। এ বলয়ে তারা আবার খুব বেশি বলীয়ান। পরস্পরে গুতোগুতিতে প্রচণ্ড শক্তিমান। কিন্তু প্রকৃত শত্রুর সামনে সে যেন ভেজা বেড়াল। ইসলামি ধারার নেতৃত্বের মধ্যে কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক আদর্শের প্রয়োগের যে বাধ্যবাধকতা, সেখানেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই মেলে না। ইসলামি ধারার নেতৃত্বের মধ্যে একপক্ষীয় চিন্তা ধারণ ও লালন করা হয়। এর অন্যতম কারণ শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা। দীর্ঘ একটি সময় পর্যন্ত যে পরিবেশে তারা লেখাপড়া করেন, সেখানকার পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার কুপ্রভাব তার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি জড়তা, জটিলতা, বাস্তববিমুখতা শেখায়। রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে দূরে থাকার শিক্ষা নিয়ে বড় হওয়া একজন আলেম হঠাৎ করেই যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন দেখা যায়, সবাইকে নিয়ে চলার মতো যোগ্যতা তার নেই। শুধু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকওয়া ও ইখলাসের গুণে মাঠে সাময়িক সমর্থন পান, পরিচিতি পান, তথাপি দীর্ঘদিনের অরাজনৈতিক চর্চার যে কুপ্রভাব, সেটা তাদের মধ্যে থেকেই যায়।

ইসলামি ধারার রাজনৈতিক লোকদের মধ্যে পেশাদারিত্ব একেবারেই কম বলা যায়। তারা বেশিরভাগ সময় কাটান মসজিদ ও মাদ্রাসার নিজস্ব পরিমণ্ডলে। সেখানকার মেজাজ আর গণমানুষের মেজাজ এক নয়। সেখানকার কমান্ডিং সিস্টেম আর সমাজকে কন্ট্রোল করার পদ্ধতি এক নয়। এ ছাড়া বড় একটি সংকট হলো, ইসলামি ধারার রাজনৈতিক চর্চার নেতৃত্বে বিত্তবান উঁচু ফ্যামিলি থেকে সদস্যের কেউ আসেন না। অভাবী, অসহায়, দুর্বল, অখ্যাত পরিবার থেকেই অনেক ধর্মীয় ধারার নেতৃত্ব উঠে আসে। ফলে তারা দেশীয় রাজনীতির মাঠে অনুসৃত নীতি ও সৌজন্যতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন খুবই কম। সামান্য অর্থের নড়াচড়া দেখলে চোখে-মুখে উষ্ণ আভা চমকে ওঠে। নিজেকে সংবরণ করা কষ্ট হয়ে যায়। কারণ, অর্থ-বিত্তের মধ্যে বসবাস করার অভিজ্ঞতা তার নেই। ৪-৫ লাখ টাকার অফারে অনেকেই হেলে পড়েন আদর্শের জায়গা থেকে। নিজেদের মধ্যে কারও কাছে অর্থ-বিত্তের নড়াচড়া দেখলে নিজেকে সামলে উঠতে পারেন না। বাংলাদেশে ইসলামি ধারার রাজনীতিবিদরা অধিকাংশই উঠে এসেছেন একেবারে দুর্বল ফ্যামিলি থেকে। স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রভাবশালী ধর্মীয় পরিবারের আবির্ভাব ঘটেনি। দ্বীন-ধর্ম ও ইহ-পরকালের ভাবনার সমন্বয় সাধনে সক্ষমতা এখানে নেই।

এর ওপর রয়েছে ধর্মীয় ধারার নেতৃত্বকে বিতর্কিত করার জন্য নানামুখি চক্রান্ত। ইসলামবিদ্বেষী শক্তির ষড়যন্ত্র তো সব সময়ই ছিল। প্রভাবশালী কোনো পরিবার থেকে ধর্মীয় নেতৃত্ব উঠে না আসায়, তারা খুব সহজেই এসব ষড়যন্ত্রের কাজে হেরে যান, হারিয়ে যান। আধুনিক যুগের গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে আলেমদের ধারণা একেবারেই কম। গোয়েন্দা শক্তির সামনে খুব সহজেই ভেঙে পড়েন আলেম সমাজ। কারণ, এদের সঙ্গে তারা আগ থেকে ওঠাবসা করে অভ্যস্ত নয়। কীভাবে ইসলামি দল ও ব্যক্তিত্বকে গোয়েন্দা শক্তিগুলো ধ্বংস করে, সে সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে।

উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) তার কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে যেভাবে কোরআন-সুন্নাহর উচ্চাঙ্গ রাজনীতির চর্চা করে গেছেন। কোরআন-সুন্নাহর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গভীর ও সূক্ষè আলোচনা করে গেছেন। তা থেকেও আমরা কিছু শিখতে পারিনি। বর্তমানে বাংলাদেশে যারা ইসলামি রাজনীতি করেন, তারা অন্তত আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক দর্শনও যদি অনুসরণ করতেন, গবেষণা করতেন, চিন্তা-চেতনায় লালন করতেন, ঘরোয়া পরিবেশে চর্চা করতেন, তাহলেও এতটা দৈন্য ইসলামি ধারার রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বে হানা দিত না। আল্লামা ইকবাল বলেন, হে মৌলবি! হিন্দুস্তানে সেজদার সামান্য একটু অনুমতি পেয়েই তুমি মনে করেছ, হিন্দুস্তান তো আমারই, হিন্দুস্তান আজ স্বাধীন। সামান্য একটু সুযোগ পেলেই যে মৌলবি ভুলে যায়, তার গোটা জাতির অধিকারের কথা, দ্বীন ও ইসলামের শান ও ঐশ্বর্যের কথা, উম্মাহর শক্তি ও বীর্যের কথা, তাকে দিয়ে তো ইসলামি রাজনীতি হবে না। তাকে দিয়ে তো জাতির পরিত্রাণ ঘটবে না। তিনি আরও বলেন, মহররম এলেই দেখা যায় কিছু মাতমকারী ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে সারাদেশে লালশালু পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এদের মধ্যে সত্যিকারার্থে না আছে হোসাইন (রা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা, না আছে তাদের মধ্যে শাহাদতের কোনো তামান্না, আশা বা আকাঙ্ক্ষা। এরা এতটাই গাফেল যে, মাতম করতে পারাটাকেই মনে করে বসে আছে, এটাই কারবালার চেতনা; এটাই হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা প্রকাশের দায়বদ্ধতা। এটাই সবচেয়ে বড় ইবাদত।

এ দেশের ধর্মীয় নেতৃত্ব যদি আল্লামা ইকবালের ১০০টি বাছাই করা পংক্তির আলোকে নিজেদের পরিচালিত করতে পারত, তাহলেও দেখা যেত রাজনীতিতে গতিশীলতা আসছে। মানুষ কাছে ভিড়ছে। কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক দাবি কী, এর গভীর অনুভূতি আলেম সমাজের অনেকের মধ্যেই নেই। অতীতের নানা কাহিনি কোরআনে বিধৃত হয়েছে। এগুলো কেন হাজারো বছর ধরে পাঠ করতে হবে? কেন এমন একটি কিতাবে মুসা (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনি বার বার আলোচিত হয়েছে? কেন ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনি এত সুন্দর করে সুবিস্তৃত আকারে তুলে ধরা হয়েছে? এগুলো থেকে বর্তমান সমাজের দ্বীনি প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কী শিক্ষা আছে? কী নির্দেশনা আছে? সেটা সম্পর্কে কতজন আলেমের ধারণা আছে? আমাদের দেশে কোরআন-সুন্নাহর সামগ্রিক পাঠের গভীরতা নেই। আছে তাবিজ আকারে গলায় ঝুলিয়ে সওয়াব কামাইয়ের ধান্দা, আছে সুরেলা কণ্ঠে রাতের গভীরে মানুষকে মাতিয়ে কিছু নগদ পয়সা হাতিয়ে নেয়ার অপকৌশল। রাসুল (সা.)-এর সিরাত পাঠ যেমন আমাদের নেই, তেমনি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়া সাহাবায়ে কেরামের রাজনীতি, আইম্মায়ে মুজতাহিদিনের আইনশাস্ত্রের অসাধারণ বিকাশ, মুহাদ্দিসিনে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ ও কষ্টের ফসল হাদিসশাস্ত্রের সংকলন ও সংরক্ষণ থেকে আমরা কতটা উপকৃত হতে পারছি!

সবাই তো ভালো করবেন না। কিন্তু কিছু লোক তো বাংলাদেশে এমন থাকা দরকার ছিল, যাদের কাছে রাষ্ট্র মাথা নত করবে। বাতিল আতঙ্কিত হবে। যে কোনো সমস্যার ধর্মীয় সমাধান দিতে সক্ষম হবে। কিন্তু আফসোস, বাংলাদেশে এমন প্রজ্ঞাসম্পন্ন আলেমের অনুপস্থিতি। সামগ্রিক জ্ঞানের অভাবই বাংলাদেশে ধর্মীয় ধারার রাজনীতিতে বেহাল দশার অন্যতম কারণ। দলীয় নেতৃত্বে যারা আছে, তাদের মধ্যে জ্ঞানের স্বল্পতা, প্রজ্ঞার দুর্বলতা বার বার দলে ভাঙন দেখা দেয়। ফলে জনমনে হতাশা তৈরি হয়। ভরসা হারিয়ে ফেলে। রাজনীতির জটিলতা বোঝার মতো জ্ঞানের অভাবে নিজেরাই খাদের কিনারে বার বার নিপতিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ধারার রাজনীতিতে বেহাল দশার বড় কারণ এটাই। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবই কোটি মানুষের সমর্থনও আমাদের মঞ্চের মধ্যমণি হওয়া থেকে দূরে রেখেছে। জানি না, এ অভাব কাটিয়ে উঠতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে। আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, এখনও সময় আছে, তুমি বদরি চেতনা একবার জাগিয়ে দেখ। তোমার সাহায্যে আকাশ থেকে দলে দলে এখনও ফেরেশতা অবতরণ করতে পারে।

লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি, জাতীয় লেখক পরিষদ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত