ইতালির রমজান সংস্কৃতি
মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ রয়েছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়া আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। দক্ষিণ ইউরোপে অবস্থিত ভূমধ্য সাগরীয় দেশ ইতালি। সেখানকার মুসলিমরা কীভাবে রমজান যাপন করেন, তা জানাচ্ছেন- হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইতালির অধিকাংশ অধিবাসী ক্যাথলিক খ্রিষ্টান; এ ছাড়া বৌদ্ধ-ইহুদিও আছে। সমগ্র জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলো মুসলমান। এ অল্পসংখ্যক মুসলমান রমজানকে ঘটা করে স্বাগত জানায়।
সভ্যতার মিশেল : ইতালিতে ইসলাম নবাগত কোনো ধর্ম নয়; বরং এর ভাগ্যোন্নয়নের অনেক কিছু হয়েছে মুসলমানদের নেতৃত্বে। ইসলামের সোনালি যুগে ইতালির ‘সিসিলি’ দ্বীপপুঞ্জ মুসলিম শাসনাধীন ছিল। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত মুসলিম কবি ও দার্শনিক ইবনে হামাদিস সিসিলি। ইতালির সমাজ আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। বিশেষত পশ্চিম ইতালির যেসব দ্বীপ আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছাকাছি, সেখানে আরব রীতিনীতি ও জীবনাচরণের ছাপ পাওয়া যায়। বর্তমানে স্থানীয় ও অভিবাসী মিলে ইতালিতে প্রায় ১৫ লাখ মুসলমান বসবাস করে। জনসংখ্যার ৪ ভাগ মুসলমান। ইতালিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫০টি মসজিদ রয়েছে।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্র : ইতালি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রাণকেন্দ্র ভ্যাটিক্যানের দেশ হলেও সেখানে ইসলামের আগমন হয়েছিল খুব সহজেই। ইতালিতে ইসলামের আগমন ঘটে সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে। পরে অবশ্য সেখানে ইসলাম প্রচারকদের একটি বড় দল ওই অঞ্চলের মানুষের মাঝে ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকে। বর্তমানে ইতালিতে ইসলামের প্রচার-প্রসারে ‘ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইতালি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
হামলার শিকার : ইসলাম প্রচারে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের কারণেই তারা কয়েকবার চরমপন্থিদের হামলার শিকার হয়েছেন। তারপরও তারা চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে ইসলামের বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন। যেসব ইতালীয় ইসলামের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক অভিযোগ উত্থাপন করে, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যুক্তির সঙ্গে তা খণ্ডন করে আসছে। ইসলাম প্রচারকরা পাল্টা আক্রমণের পরিবর্তে চরমপন্থিদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন।
স্বচ্ছ ধারণার অভাব : ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে ইতালিতে বেশ কয়েকটি ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে মুসলিম সোসাইটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ইসলাম সম্পর্কে শাসকদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব। ফলে তারা ইসলাম বিষয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেল করার অনুমতি এখনো পায়নি। তাই ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র একটি অনলাইন টিভি চ্যানেলের অনুমতি লাভের চেষ্টা করছে। এমনকি ইতালিতে মুসলমানদের রীতি অনুসারে দাফন করারও অনুমতি দেওয়া হয় না।
রমজানের সম্মান : রমজানে কোথাও কোথাও প্রশাসন কিছুটা নমনীয়তা দেখায়। তাই মুসলমানরা ইফতার পার্টি করার অনুমতি পায়। ইতালিতে মুসলমানরা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় তাঁবু করে তারাবির নামাজ আদায় ও ইফতার করে। রমজানে ইতালির সরকার এসব খুব একটা বাঁধা দেয় না।
ধর্মচর্চার সুযোগ : রমজান মাসকে ইতালির মুসলমানরা ধর্মচর্চা ও ইবাদতের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। এ সময় তারা মুসলিম দেশে তৈরি পণ্য ও খাবার গ্রহণ করে। শহরের মুসলিম হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ইফতার ও সাহরি করে। ইফতারিতে তারা বার্গার জাতীয় খাদ্য, নানাবিধ ফল (যেমন- মাল্টা, আপেল, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফলের রস) খায়। সাহরিতে বার্গার ও বার্গার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে থাকে।
আরবের প্রভাব : রমজান মাসে ইতালির মুসলমানরা আরবীয় খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করেন; যা তাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। রমজান মাসে আরব দেশ থেকে আমদানি করা প্রচুর খাবার ইতালিতে পাওয়া যায়। যার উল্লেখযোগ্য অংশ যায় উপহার হিসেবে। ইতালির মুসলিম কমিউনিটিগুলো রমজানে ইসলামি বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করে। সেখানে সাধারণত আরব আলেমদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ইফতার বাজার : রমজান উপলক্ষে ইতালির ভেনিসের কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইফতারি পণ্যের জমজমাট বাজার গড়ে ওঠে। ইতালির এ বন্দর নগরীতে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। বিশেষ করে, ভেনিসের মেসত্রে ও মারঘেরাতে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস। এখানেই গড়ে উঠেছে বহু বাংলাদেশি মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর কয়েকটি দোকান ইফতারের জন্য জনপ্রিয়। এসব দোকানে ছোলাবুট, পিয়াজু, বেগুনি, বুন্দিয়া, আলুর ডিমচপ, হালিম, শরবত, লাচ্ছি, জিলাপিসহ নানা রকম খাবার তৈরি হয়।
প্রবাসীর ইফতার : প্রবাসীরা এসব দোকান থেকে পণ্য কেনার পাশাপাশি পরিবার নিয়েও ইফতার করতে আসেন। মেসত্রের আল মদিনা বাংলা মিষ্টিঘর ও দেশ ফাস্টফুড এবং মারঘেরার বাংলা মিষ্টিঘরসহ বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় বসে ইফতার সেরে নেন।
অভিবাসীর ইফতার : রমজান মাসে ইতালির মুসলিম অধিবাসী এবং বিভিন্ন দেশের মুসলিম অভিবাসীরা পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ লাভ করেন। সাধারণত তারা সবাই সপরিবারে মসজিদে ইফতার করেন। ইফতার অনুষ্ঠানে অভিবাসীরা নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করে নিয়ে আসেন। মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করে ঘরে ফেরেন।
দান-অনুদান : মাহে রমজানে ইতালীয় মুসলিমরা দু’হাত খুলে দান করেন। তারা অনুন্নত ও দুর্দশাগ্রস্ত মুসলিম অঞ্চলের জন্য দান করতে বেশি পছন্দ করেন। যেমন- ফিলিস্তিন ও আফ্রিকার দরিদ্র্য অঞ্চলের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দান করেন।