ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
যার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ

চুরির অপরাধে দণ্ডিত হয়ে রাশিয়ার কারাগারে বন্দি ছিলেন ২২ বছর বয়সি আন্দ্রেই ইয়াসত্রেবভ। একদিন তার কাছে একটি প্রস্তাব আসে। বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। সঙ্গে মিলবে মোটা অঙ্কের বেতন। প্রস্তাবে রাজি হন তিনি। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দেন যুদ্ধে। এখন ইয়েসত্রেবভ আবার নিজ দেশে ফিরেছেন। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হয়ে। পরিবারের ভাষায়, ‘তিনি সব সময় এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকেন।’

যুদ্ধে যোগদানের সূত্রপাত : ইয়েসত্রেবভ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনারের হয়ে। রাশিয়ার অনেক অপরাধীই কারামুক্ত আর অর্থের লোভে ওয়াগনারে যোগ দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছেন। ইয়েসত্রেবভের মতো অনেকে আবার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় রাশিয়ায় ফিরে আসছেন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ফিরে আসা এ যোদ্ধাদের মধ্যে ভয়ংকর অপরাধীও রয়েছেন। সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া এ অপরাধীদের যদি শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করে দেওয়া হয়, তাহলে তারা রাশিয়ার জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারেন।

অর্থের প্রলোভন : ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন বলেছিলেন, কোনো কারাবন্দি ওয়াগনারে যোগ দিয়ে যুদ্ধে গেলে তাকে প্রতি মাসে ১ লাখ রুবল বেতন দেওয়া হবে। ১ লাখ রুবল মানে বাংলাদেশের হিসেবে ১ লাখ ৫১ হাজার টাকা। গত বছরের জুলাই থেকে প্রায় ৪০ হাজার রুশ কারাবন্দি ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পশ্চিমা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, ইউক্রেন সরকার ও রাশিয়ার কারাবন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘রাশিয়া বিহাইন্ড বারস’। কারাবন্দিদের এ তালিকায় চুরি ও ডাকাতি থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরাও রয়েছেন। এ অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়ে রাশিয়া বিহাইন্ড বারসের প্রধান ওলগা রোমানোভা বলেন, ‘এখন তারা যে কোনো কিছু করতে পারবেন। এটা দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।’

বন্দিদের সংগ্রহ যখন শুরু : ছয় মাসেরও বেশি সময় আগে রাশিয়ার বিভিন্ন কারাগার থেকে এ বন্দিদের সংগ্রহ করা শুরু করে ওয়াগনার ও বাহিনীটির প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য এত বড় পরিসরে বন্দিদের সংগ্রহ করার ঘটনা ঘটেনি। এসব বন্দির ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বাখমুত শহরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে ওয়াগনার মূলত ছয় মাসের চুক্তি করেছে। চুক্তি শেষে চলতি মাসে তারা রাশিয়ায় ফিরতে শুরু করেছেন। সামনের দিনগুলোতে এই ফেরার সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

গুলি করে হত্যার হুমকি : যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কেউ পালিয়ে গেলে, মাদক সেবন করলে বা শারীরিক সম্পর্ক করলে তাদের মৃত্যুর সাজা দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন প্রিগোঝিন। এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ইউক্রেনে যাওয়ার পর মনে করেন, আমাকে ভুল জায়গায় পাঠানো হয়েছে, তাদের পলাতক বলে ধরে নেওয়া হবে এবং গুলি করে হত্যা করা হবে।’

এ অপরাধীরা দেশে ফিরছেন মেডেল, অর্থ ও কিছু নথিপত্র সঙ্গে নিয়ে। ওয়াগনার দাবি করছে, নথিগুলো তাদের কারাগার থেকে মুক্তির সনদ। এ নিয়ে ওয়াগনার বা রাশিয়ার বিচার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করেনি। তবে রুশ কারাবন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ইয়ানা গেলমেল বলেন, ‘মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এই মানুষগুলো রাশিয়ায় ফেরার পর মনে করছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তারা হত্যা করেছেন মাতৃভূমিকে বাঁচাতে। তারা খুবই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেন।’

ক্রেমলিনের সমর্থনে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্বরতা : কারাবন্দিদের ওয়াগনারে নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস। এসব পক্ষের মধ্যে রয়েছে ওয়াগনারের হয়ে যুদ্ধ করার পর দেশে ফিরে আসা কারাবন্দি, তাদের আত্মীয়, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবিসহ বিভিন্নজন। তাদের বক্তব্যে ওয়ানগারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধক্ষেত্রের বর্বরতা ফুটে উঠেছে। আর এ সবকিছুই হয়েছে ক্রেমলিনের সমর্থনে। রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী শুধু দেশটির রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনই সাধারণ ক্ষমা করতে পারেন। ২০২০ সাল থেকে দেশটিতে সাধারণ ক্ষমার কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

আত্মহত্যার মতো অভিযান : টাইমসের সঙ্গে কথা বলা এমনই একজন আন্দ্রেই মেদভেদেভ। তিনি দক্ষিণ রাশিয়ায় একটি কারাগারে বন্দি ছিলেন চুরির দায়ে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক দিন পরেই ওয়ানগারে যোগ দেন। ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মেদভেদেভ বলেন, বাখমুতে কারাবন্দি নিয়ে তৈরি ওয়াগনারের একটি যোদ্ধা দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তাদের যে অভিযানে পাঠানো হয়েছিল, তা বলতে গেলে প্রায় আত্মহত্যার মতো।

আশ্রয়ের জন্য আবেদন : যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে নরওয়ে চলে গিয়েছিলেন মেদভেদেভ। দেশটিতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। ফোনকলে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাখমুতের ওই অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল, যতক্ষণ না মারা যাচ্ছি, ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।’ গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের কাছে একটি কারাগারে দেখা গিয়েছিল ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনকে। সেখানে কারাবন্দিদের উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াগনারের হয়ে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তারা সমাজের প্রতি তাদের ঋণ শোধ করতে পারবেন। প্রিগোঝিনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।

প্রিগোঝিনের হুঁশিয়ারি : ওই ভিডিওতে তিনি বলেন, কোনো কারাবন্দি ওয়াগনারে যোগ দিয়ে যুদ্ধে গেলে তাকে প্রতি মাসে ১ লাখ রুবল বেতন দেওয়া হবে। এই অর্থ রাশিয়ার বাসিন্দারা প্রতি মাসে গড়ে যে বেতন পান, তার দ্বিগুণ। একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রিগোঝিন। আর চুক্তি শেষে ছয় মাস পর কেউ বেঁচে ফিরতে পারলে মিলবে কারাগার থেকে মুক্তি। তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কেউ পালিয়ে গেলে, মাদক সেবন করলে বা শারীরিক সম্পর্ক করলে তাদের মৃত্যুর সাজা দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন প্রিগোঝিন।

সফরের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন : প্রিগোঝিনের ওই কারাগার সফরের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, রুশ আইন অনুযায়ী দেশটির কারাবন্দিদের কোনো ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তবে বেশ আঁটঘাট বেধেই নেমেছেন প্রিগোঝিন। যেসব কারাবন্দি ওয়াগনারে যোগ দিয়েছেন, তাদের আত্মীয়দের সরবরাহ করা নথিপত্রে দেখা গেছে, ওই কারাবন্দিরা আদৌ যুদ্ধে যাননি বলে কাগজকলমে দেখানো হয়েছে। সেখানে বরং উল্লেখ করা হয়েছে, ওই বন্দিদের ইউক্রেন সীমান্তের কাছে কারাগারগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

কারাবন্দি আনাস্তাসিয়ার গল্প : কারাবন্দিদের এমন আত্মীয়দের একজন আনাস্তাসিয়া। নিজের নামের শেষাংশ প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। আনাস্তাসিয়া বলেন, তার ওই আত্মীয় ওয়াগনারের হয়ে ইউক্রেনে নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছিলেন। এ নিয়ে খুবই গর্বিত ছিলেন তিনি। কারণ, অপরাধী হিসেবে নিজের মায়ের সামনে যেতে লজ্জা পেতেন। তবে যে কারাগারে ওই আত্মীয় বন্দি ছিলেন, সেখান থেকে তার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি আনাস্তাসিয়াকে। শুধু এটুকু বলা হয়েছিল, তিনি আর সেখানে নেই।

ফেরারী ইগর মাতিউখিন : যুদ্ধে যোগ দেওয়া আরেক কারাবন্দি ২৬ বছর বয়সি ইগর মাতিউখিন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভে তিনি ইউক্রেন গিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে ওয়াগনারের কর্মকাণ্ডে হতাশ হন। মাতিউখিনের ভাষ্যমতে, ভয় দেখিয়ে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হতো।

এমনকি হত্যার হুমকিও দেওয়া হতো। তার সেনাদলের অন্তত একজনকে নির্দেশ না মানার অভিযোগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওই ব্যক্তি আর কখনও ফেরেননি। পরে সুযোগ বুঝে একদিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান মাতিউখিন। বর্তমানে রাশিয়াতেই পালিয়ে আছেন তিনি। চেষ্টা করছেন আবার কারাগারে ফিরে যেতে।

অভিনব কৌশল ওয়াগনারের : এদিকে কারাবন্দি যোদ্ধাদের সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকাতে একটি কৌশল ফেঁদেছে ওয়াগনার। ভিডিও প্রকাশ করে দেখানো হচ্ছে, চুক্তি শেষে যোদ্ধাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এমনই একটি ভিডিওতে প্রিগোঝিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি চাই যুদ্ধে শত্রুদের হত্যা করতে আপনারা আপরাধী বুদ্ধি কাজে লাগান। যারা ফিরে আসতে চান, আমরাও তাদের সেই সুযোগ দিতে চাই। যারা বিয়ে করতে চান, পড়ালেখা করতে চান, আমার আশীর্বাদ নিয়ে তারা এগিয়ে যাবেন।’

মানবাধিকারকর্মীদের মন্তব্য : কয়েকটি ভিডিওতে আবার দেখা গেছে, চুক্তি শেষে যুদ্ধ থেকে ফেরার পর কারাবন্দিদের সনদ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সেগুলো নাকি কারাগার থেকে মুক্তি অথবা অপরাধের দায়মুক্তির সনদ। তবে এই সনদগুলো কখনও জনসমক্ষে আনা হয়নি। তাই সেগুলো আদৌ আসল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সাজা ক্ষমা করে দেওয়া বিরল, সময়সাপেক্ষ ও জটিল একটি আইনি বিষয়। আর ওয়াগনার যে সংখ্যক কারাবন্দিকে সাধারণ ক্ষমা বা মুক্তি দেওয়ার প্রচার-প্রচারণা করছে, তা শুধু রাশিয়া কেন, বিশ্বে কোথাও কখনও হয়নি।

প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয় : রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী শুধু দেশটির রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনই সাধারণ ক্ষমা করতে পারেন। ২০২০ সাল থেকে দেশটিতে সাধারণ ক্ষমার কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে গত শুক্রবার পুতিনের প্রেসসচিব দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, যেসব কারাবন্দি ওয়াগনারে যোগ দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করেছেন, তাদের রাশিয়ার আইন মেনেই ক্ষমা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিস্তারিত বলেননি তিনি। এটুকু জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয়।

অস্পষ্টতায় বিচারব্যবস্থার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ : রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, সাধারণ ক্ষমার সব আবেদন যাচাই-বাছাই করে দেখেন বিশেষ আঞ্চলিক কমিটিগুলো। এরপর সেগুলো ক্রেমলিনে যায়। এই কমিটিগুলোর দু’জন সদস্য জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ওয়াগনারে যোগ দেওয়া কারাবন্দিদের সাধারণ ক্ষমা চেয়ে কোনো আবেদন আসেনি। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ কারাবন্দিদের ক্ষমার বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রাশিয়ার বিচারব্যবস্থার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে। একই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ ওয়াগনারের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত