মেগা প্রকল্পের পরও ঢাকা কেন ধীরগতির শহর
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এ শহরে গাড়ির সংখ্যার হিসেবে যথেষ্ট রাস্তা নেই। এ কারণে যানজট এ নগরীর দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। সংস্থাটির তালিকায় শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের মধ্যে আরো আছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা এবং কুমিল্লা। অথচ যানজট নিরসন করে শহরকে গতিময় করতে ২০১২ সালের পর থেকে গত এক দশকে সড়ক, সেতু, মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ সময়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ এবং মেট্রোরেলের একটি রুটের একাংশ ছাড়াও শহরের মধ্যে ছোট-বড় অন্তত সাতটি নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু তাতে কোনো কোনো জায়গায় কমে এলেও শহরের সার্বিক যানজট অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ফ্লাইওভারের ওপরেও দীর্ঘ সময়ের যানজট দেখা যাচ্ছে প্রায়ই।
প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম : একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এ শহরে। অন্যদিকে ট্রাফিক বিভাগের হিসাবমতে, ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এ ছাড়া ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট। ১৫ শতাংশ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ শতাংশেরও বেশি সড়ক। বাকি ৮৫ শতাংশ যাত্রী অন্য ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। ঢাকায় সুনির্দিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় অফিস এবং ব্যবসা-বাণিজ্য চলাকালে ৮০ শতাংশ গাড়ি ব্যস্ত সড়কে যত্রতত্র পার্ক করা হয়। তা ছাড়া ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেললাইন যাওয়ার ফলে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিবিদদের মুভমেন্টের সময় দীর্ঘক্ষণ কিছু কিছু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী সড়কে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। ঠেলাগাড়ি-বাস একই রাস্তায়। যেমন একই রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহন আর ধীরগতির গাড়ি চলাচল করে, তাও আবার একসঙ্গে। একই সড়কে বাস-মিনিবাস, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, এমনকি ঘোড়ার গাড়িও চলে এবং নিবন্ধিত রিকশার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রিকশা চলাচল করে। ফলে যানবাহনের গতি কমে যায়।
কখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট নিরসনে শহরকে গতিশীল রাখা কিংবা গতিময় করার চিন্তা থেকে এ শহরে কখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং নগর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালুর চেষ্টাও কার্যকর করা যায়নি। বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ‘মানুষকে পর্যাপ্ত গণপরিবহন দেয়ার মতো কৌশলী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মানসিকতাই এখানে নেই। বরং যানজট থেকে গেলে অনেকে খুশি হন। কারণ, তারা পরের প্রকল্প নিতে পারেন।’ বুয়েটের আরেকজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলছেন, ‘শহরের যানজট নিয়ে কখনও কার্যকর কোনো গবেষণাও করেনি কর্তৃপক্ষ। এখানে একই সড়কে আঠার ধরনের যানবাহন চলছে। গতি আসবে কীভাবে! মূল সড়কগুলোর পাশে নিয়মনীতি না মেনে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করা হয়েছে। জংশন বা স্টেশনগুলোতে ইন্টারচেঞ্জ বানানোর সুযোগই রাখা হয়নি।’
মার্কিন সংস্থার মতামত : পৃথিবীর ১৫২টি দেশের দু’শোর বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে ধীরগতির ২০ শহরের মধ্যে ঢাকার পরেই আছে নাইজেরিয়ার দুটি শহর। যানবাহনের চাপ কম থাকলেও বাংলাদেশের চারটি শহর ধীরগতির শহর হিসেবে ওই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে যে সময় লাগে, দ্রুতগতির শহরে সেই একই দূরত্বে চলাচল করতে তিনগুণ কম সময় লাগে। তা ছাড়া বাংলাদেশে শহরগুলোর তুলনায় একই আয়তনের অন্য দেশের শহরে জনসংখ্যা ৪০ ভাগ; কিন্তু তাদের বড় সড়ক ৪২ শতাংশ বেশি। মূলত এগুলোকেই মার্কিন সংস্থাটি ঢাকাসহ বাংলাদেশের শহরগুলো ধীরগতি হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এদিকে ঢাকার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডিও বুধবার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীবাসীর প্রতি দুই ঘণ্টার যাত্রাপথের ৪৬ মিনিটই কাটে যানজটে বসে থেকে। যার ফলে অতিরিক্ত সময় নষ্ট হয় এবং কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
ঢাকা ধীরগতি হওয়ার কারণ : সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যোগাযোগের নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে। কিন্তু তারপরও শহরের যানজট পরিস্থিতির অবনতিই ঘটে চলেছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার; যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক আট কিলোমিটারে। এরপর ২০২৫ সাল নাগাদ এটি চার কিলোমিটারের নিচে চলে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমেছে ঘণ্টায় অন্তত ১৬ কিলোমিটার। অথচ একের পর এক ফ্লাইওভার আর নিত্য নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শহরজুড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে প্রায় আট থেকে ১০ বছর।
রাইড শেয়ারিংকে জনপ্রিয় করেছে : অধ্যাপক সামছুল হক বলছেন, ‘যানজট নিরসনের জন্য টেকসই পদ্ধতির কথা কখনও চিন্তা করা হয়নি। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সটাই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং সমাধানের জন্য যা করা হচ্ছে, তা যানবাহনের সংখ্যার তোড়ে ভেসে যাচ্ছে।’ এরপর ২০১৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং পরিসেবা শুরু হয়। মোটরসাইকেলের অন্তর্ভুক্তি রাইড শেয়ারিংকে আরো জনপ্রিয় করেছে। এরপর গত ৬ বছরে ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় আট লাখ। বিআরটিএ’র হিসেবে, ২০১০ সালে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩১৩। আর ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৭ হাজার ৪৮৪টিতে। অর্থাৎ সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যাই বেড়েছে; কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় গণপরিবহনের সঠিক বিন্যাস করা হয়নি। আবার নিম্নমানের বাস-মিনিবাস মানুষের উপকারে না এসে বরং যান চলাচলে শৃঙ্খলাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে বলেও মনে করেন অনেকে।
চক্রাকার বাস সার্ভিস সফল : অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলছেন, ‘ঢাকায় বন্যার পানির মতো নতুন যানবাহন নামছে; কিন্তু এটি করা হচ্ছে চাহিদা ও সাপ্লাইয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছাড়াই। অনেক যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেছে। তারা সড়কে বিশৃঙ্খলতা তৈরি করছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। বরং সবাই ব্যস্ত বড় প্রকল্প নিয়ে।’ এর মধ্যেই ঢাকায় মেট্রোরেলের একাধিক রুট ও বিআরটির কাজ শুরু বা চলমান রয়েছে।
যদিও মেট্রোরেলের উত্তরা-মতিঝিল রুটই পরিপূর্ণভাবে আগামী জুনের আগে চালু সম্ভব হয় কি না, তা নিশ্চিত নয়। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুট অক্টোবরে উদ্বোধন করা হবে কয়েকটি স্টেশন চালু না করেই। সামছুল হক অবশ্য বলছেন, বিলাসী প্রজেক্টগুলো শর্ট টার্ম ভ্যালু অ্যাড করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলো দিয়ে শহরের যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে লাভ হয় না। তিনি বলছেন, হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিস সফল হয়েছে। কারণ, সেটি মানুষের উপযোগিতা বুঝে মানসম্মত বাস দিয়ে চালু করা হয়েছে এবং সেগুলো নিয়ম মেনে চলাচল করছে।
সমন্বিত উদ্যোগে হবে যানজট নিরসন : অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলছেন, ‘সমন্বিত উদ্যোগ নেই বলেই যানজট নিরসনে কোনো কাজ হচ্ছে না।’ তার মতে বিআরটি, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে গণপরিবহন না আনলে শহরকে গতিময় করা অসম্ভব হবে। প্রসঙ্গত ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য বিশ বছরের যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সরকার অনুমোদন করেছিল, সেটি বাস্তবায়ন সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এ পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের প্রবণতা ও যানজট বিবেচনায় নিয়ে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের মাথায় এসে তিনটি রুটে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা চালু হলেও এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে এখনই প্রশ্ন উঠছে।
যদিও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য নগর পরিবহনকে ঢেলে সাজাতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যে কাজ করছে, তাতে ঢাকা থেকে টার্মিনালগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী গাবতলী টার্মিনাল সরিয়ে হেমায়েতপুরে এবং সায়েদাবাদ টার্মিনালকে সরিয়ে মদনপুরে নেয়ার কাজ চলছে। কিন্তু এগুলোও আসলে শহরের মধ্যে যানজট নিরসনে কী ভূমিকা রাখবে, তার কোনো গবেষণাভিত্তিক উত্তর কারও জানা নেই।
যত বড় বড় প্রকল্প হলো : চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে যান চলাচলের জন্য কাওলা থেকে শুরু করে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ? ১১ কিলোমিটারের অংশটুকু খুলে দেয়া হয়। চট্টগ্রামের কুতুবখালী পর্যন্ত পুরো ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পের মোট খরচ হবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরের জুনে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, শহরের মধ্যে অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে এ প্রকল্পটিই শহরের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় নতুন করে যানজটের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এর আগে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-কালশী ফ্লাইওভার উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ হাজার ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। এটি মিরপুর, পল্লবী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, মহাখালী ও রামপুরার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ আরো সহজ করেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলে আসছে।