যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গত শুক্রবার সকালের দিকে ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। যা আসলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুই দেশের মধ্যে চলমান অস্থিরতায় একটা প্রতিশোধমূলক হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইস্ফাহান অঞ্চলে এ হামলার ব্যাপকতা ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য দেখা যাচ্ছে। যেখানে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের গুরুত্ব খুবই সামান্য বলে প্রচার করেছে। এ হামলার ঘটনা ঘটল যখন একই অঞ্চলে দুই শত্রু দেশের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বিরাজমান। এর আগে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেট ভবন লক্ষ্য করে হামলা করে ইসরায়েল। তারপর ইরান ইসরায়েলে এক নজিরবিহীন হামলা চালায়।
হামলার ব্যাপারে যেভাবে জানা যাচ্ছে : ইসরায়েল সাধারণত তাদের সামরিক পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে নিয়মিতভাবে বিবৃতি দিয়ে জানায় না, যেমনটা তারা এর আগে বহুবার ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে ইরাক ও সিরিয়ায় হামলা করেছে। তবে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র যে ইরানে আঘাত করেছে, সে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করা হয় গণমাধ্যমকে। যুক্তরাষ্ট্রের সূত্র বলছে, এ হামলায় ক্ষেপণাস্ত্র ছিল; অন্যদিকে ইরান বলছে, কিছু ছোট ড্রোন দিয়ে হামলা করা হয়। দেশজুড়ে প্রবেশাধিকার কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইরানের সরকার। সরাসরি যেখানে ঘটনা ঘটেছে, সেই মধ্যাঞ্চলের ইস্ফাহানে গণমাধ্যমকর্মীরা যেতে পারেনি।
যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে : এখন পর্যন্ত কী ধরনের মিসাইল ব্যবহার হয়েছে, তা নিয়ে নানা মতবাদ দেখা যাচ্ছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ৪৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি অঞ্চল থেকে যে মিসাইলের অংশবিশেষের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি বিশ্লেষণ করে শনাক্তের চেষ্টা করে গণমাধ্যম। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ধারণা, দুই ধাপের মিসাইল এতে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্ভবত আকাশ থেকেই এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। অনেকে এর ধ্বংসাবশেষকে শনাক্ত করছেন ইসরায়েলিদের তৈরি ব্লু স্প্যারো মিসাইল হিসেবে। জাস্টিন ক্রাম্প, সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা যিনি এখন রিস্ক ইন্টিলিজেন্স কোম্পানি সিবিলাইন চালান, তিনিও এ ব্যাপারে একমত যে, ধ্বংসাবশেষ যেটি পাওয়া গেছে, সেটি সম্ভবত কোনো মিসাইল বুস্টারের, ‘এটি থেকে সমরাস্ত্র আগেই উৎক্ষেপিত হয়ে গেছে এবং সম্ভবত সে তার মিশনও সম্পূর্ণ করেছে। এটি হলো সেটার মোটর, যা মাটিতে পড়েছে। এ বুস্টারে কিছু পয়েন্ট আছে, যা সাধারণত কোনো এয়ারক্রাফটকে যুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এর আকার বলে দেয়, এটা সম্ভবত এয়ার-লাঞ্চড সিস্টেম। যদিও আমরা এখনও স্বতন্ত্রভাবে এটা যাচাই করতে পারিনি যে, ঠিক কী ধরনের মিসাইল ছিল। তবে জানা যায় যে, ইসরায়েল এ ধরনের অস্ত্র তৈরি করেছে।’ মি. ক্রাম্প আরো যোগ করেন, ‘ইসরায়েল এর আগে এ ধরনের অস্ত্র সিরিয়ায় ব্যবহার করেছে। তাই অবশ্যই তাদের সেই সামর্থ্য আছে।’
হামলা নিয়ে ইরান যা বলছে : কিছু ইরানি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে যে, একটা হামলার চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু সেটার ব্যাপকতা খুব সামান্য বলছে তারা। কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ইরানের ফারস নিউজ এজেন্সি জানায়, একটা সামরিক ঘাঁটির পাশে বিস্ফোরণ শোনা গেছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সচল হয়ে ওঠে। তবে একটি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এক জেনারেলের বক্তব্যের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইস্ফাহানে যে বিস্ফোরণ শোনা গেছে, তা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে সন্দেহজনক কিছুর দিকে গুলি ছোঁড়ার কারণে।’ আর দেশটির আধা সরকারি তাসনিম নিউজ এজেন্সি, যারা শক্তিশালী ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের সামরিক শাখার ঘনিষ্ঠ, তারা ইস্ফাহানের পারমাণবিক স্থাপনার একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। আন্তর্জাতিক অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সিও নিশ্চিত করেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কোনো ক্ষতি হয়নি। ইরানের জাতীয় সাইবারস্পেস কেন্দ্রের মুখপাত্র হোসেইন দালিরিয়ান জানান, ‘সীমান্তের বাইরে থেকে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।’ তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল শুধু কোয়াডকপ্টার (ড্রোন) ওড়ানোর ব্যর্থ ও লজ্জাজনক একটা চেষ্টা চালিয়েছে; যা ভূপাতিত করা হয়।’ এ হামলার পরপরই অবশ্য ইরান বাণিজ্যিক বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়; কিন্তু পরে সেটি তুলেও নেওয়া হয়। কাছাকাছি সময়ে ইরাক ও সিরিয়াতেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। যেখানে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, ইস্ফাহানের হামলার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কি-না। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত শুক্রবার সকালে তাদের প্রতিরক্ষা স্থাপনার ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানালেও ইসরায়েল এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইস্ফাহান কেন লক্ষ্যবস্তু হলো এবং এ সময়ে হামলা কেন : ইস্ফাহান প্রদেশটা হলো ইরানের কেন্দ্রে অবস্থিত; যার নামকরণ করা হয়েছে প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহরটির নামে। এ অঞ্চলটা ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় ভরা। যার মধ্যে আছে একটা বড় বিমান ঘাঁটি, একটা প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কমপ্লেক্স এবং বেশকিছু পারমাণবিক সাইট। ইসরায়েল সাধারণত আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে এ রকম সামরিক অভিযানের ব্যাপারটা জানিয়ে থাকে। তবে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি কাপরিতে জিসেভেনের সভায় সাংবাদিকদের জানান, এবার ওয়াশিংটন একেবারে শেষ মুহূর্তে জেনেছে। একই সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন শুধু এটুকু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো রকম আগ্রাসী অভিযানে যুক্ত হয়নি। এ হামলার ঘটনা ঘটল ইরান ইসরায়েল লক্ষ্য করে শত শত মিসাইল ও ড্রোন ছোঁড়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই। তবে ব্যাপক আকারে এমন নজিরবিহীন হামলার পরও, ইরানের হামলা বড় আকারে ব্যর্থই হয়; কারণ, ছুটে আসা বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য মিত্রদের সহায়তায় ঠেকিয়ে দেয় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইসরায়েলের মাটিতে ইরান এ নজিরবিহীন হামলা করে গত পহেলা এপ্রিল সিরিয়ায় তাদের কূটনৈতিক ভবনে ইসরায়েলের হামলার জবাব হিসেবে।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা কি এখন আরো বাড়বে : সবশেষ এ হামলার ব্যাপারে পুরোপুরি এখনও জানতে বাকি আছে; এটাও এখনও জানা যাচ্ছে না যে, ইরান এর কোনো উত্তর দেবে কি-না। গত শুক্রবারের এ হামলাকে খুবই সীমিত আকারে ও এমনভাবে করা হয়েছে বলে বর্ণনা করেন অনেক গণমাধ্যমকর্মী, যাতে উত্তেজনা আর না ছড়ায়। আর বিবিসির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন মনে করেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিজের কিছু জেনারেল ও রাজনৈতিক মিত্ররা তাকে চাপ দিচ্ছে ইরানের সঙ্গে সংঘাতে না যেতে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের দিক থেকেও ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক চাপ ছিল, যাতে তারা এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়; যা এ দুই দেশের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধকে সরাসরি যুদ্ধে রূপ দেয়।
ইসরায়েল ও বাকি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী : ইসরায়েল থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে, তার কিছু কিছু দেশটির রাজনৈতিক মতভেদের বিষয়টি সামনে এনে দিয়েছে। নিরাপত্তা মন্ত্রী আল্ট্রান্যাশনালিস্ট ইতেমার বেন গাভির ইরানে হামলা করাকে ক্ষীণ বা সামান্য বলে বর্ণনা করেছেন। এর জবাবে ইসরায়েলের বিরোধী দলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ তাকে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন। কারণ, তার এ মন্তব্য ইসরায়েলকে ছোট ও বিব্রত করেছে বলে মনে করেন তিনি। যুক্তরাজ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তারা হামলার বিষয়ে কিছু বলবে না, তবে তাদের বক্তব্য ছিল ইসরায়েলের আত্মরক্ষা করতে গিয়ে এমন কিছু করা থেকে বিরতি থাকা উচিত, যা সহিংসতা উস্কে দেয়। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন দু’পক্ষকেই আর কোনো হামলায় জড়ানো থেকে বিরতি থাকার আহ্বান জানান।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব পড়েছে : ইসরায়েল-গাজার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে আরো সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে তা তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে। ব্রেন্ট ক্রুড, তেলের মূল্য নির্ধারণের আন্তর্জাতিক মানদ-ে, এ হামলার পর প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১.৮ শতাংশ বেড়ে ৮৮ ইউএস ডলারে পৌঁছায়। এক পর্যায়ে তেলের দাম ৩.৫ শতাংশ লাফিয়ে বেড়ে যায়। কিন্তু পরে এটি নিয়ন্ত্রণে আসে, যখন এ সীমিত হামলার বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এখন যা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়, সেই সোনার দাম অনিশ্চয়তার সময়টাতে প্রায় রেকর্ড দামের কাছাকাছি পৌঁছায়। পরে অবশ্য তা প্রতি আউন্স ২৪০০ ইউএস ডলারে নেমে আসে।