ইস্ফাহানকে নিশানা করার কারণ

প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

প্রাসাদ, মসজিদ আর মিনারের জন্য বিখ্যাত ইরানের ইস্ফাহান শহর। আবার এ শহরটিই সামরিক শিল্পেরও একটি প্রধান কেন্দ্র। গত বৃহস্পতিবার রাতভর এ শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইস্ফাহান ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এর নাম ‘নিসফ-ই-জাহান’ বা অর্ধ পৃথিবী। শহরটি ইরানের মাঝামাঝি জাগ্রোস পর্বতমালার কাছে অবস্থিত। শহরটিতে ও তার আশপাশের এলাকায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রটিও এ শহরের কাছে। ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এ নাতাঞ্জ। ইস্ফাহানের নাম ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই ওই শহরে বৃহস্পতিবারের হামলাকে প্রতীকী হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইস্ফাহান আক্রমণ করল যারা : এটা যদি ইসরায়েলি হামলা হয়ে থাকে, তাহলে মনে হচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইরানকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ইরানকে বলার চেষ্টা করেছে যে, ওই এলাকার সংবেদনশীল লক্ষ্যগুলোতে হামলা চালানোর ক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে। যদিও এখনই সেরকম হামলা করা হচ্ছে না। ইরানি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা করেন যে, ইস্ফাহান প্রদেশের পরমাণু স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। ইরানের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই।

দেশটি এটাও অস্বীকার করে যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য দেশের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে গত বৃহস্পতিবার রাতে যা ঘটেছে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ইরানের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন ডেলিরিয়ান বলেছেন, বেশ কয়েকটি ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর নাকচ করে দিয়েছেন ওই মুখপাত্র। আবার ইরানের কয়েকটি গণমাধ্যম ইস্ফাহান বিমানবন্দর ও একটি সামরিক বিমান ঘাঁটির কাছে তিনটি বিস্ফোরণের খবর দিয়েছে। তবে এ হামলা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করেনি ইরান।

ইরান যা বলেছে : বিস্ফোরণগুলোর কারণ হিসেবে ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ আবদুর রহিম মুসাভি দায়ী করছেন একটি সন্দেহভাজন বস্তুর ওপরে বিমান বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুলি নিক্ষেপের ঘটনাকে। ইরানি গণমাধ্যম ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিনটি ড্রোন জড়িত ছিল; যেগুলো অনুপ্রবেশকারীরা আকাশে উড়িয়েছিল। ইস্ফাহান বিমানবন্দরে ইরানের বিমান বাহিনীর একটি ঘাঁটি রয়েছে। সেখানে কিছু পুরোনো এফ-ফর্টিন যুদ্ধবিমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-ফর্টিন যুদ্ধবিমানগুলো ১৯৭০-এর দশকে শাহ’র শাসনকালে সংগ্রহ করে ইরান।

আগেও হামলা হয়েছে ইস্ফাহানে : এর আগেও সন্দেহভাজন ইসরাইলি হামলার শিকার হয়েছে ইস্ফাহান। গত বছরের জানুয়ারিতে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি গোলাবারুদের কারখানায় ড্রোন হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। চারটি প্রপেলারসহ একটি ছোট ড্রোন ‘কোয়াডকপ্টার’-এর মাধ্যমে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের অন্যান্য অংশেও একই ধরনের ড্রোন হামলার খবর পাওয়া গেছে। ওইসব হামলার কোনোটিতেই জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি ইসরায়েল।

ইস্ফাহান কেন নিশানায় : রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর পারমাণবিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হামিশ ডি ব্রেটন-গর্ডন। তিনি বলেন, ইস্ফাহানকে নিশানা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর আশপাশে অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ইরান যেখানে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে বলে আমরা মনে করি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি তার খুব কাছেই হয়েছিল। তাই এটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। তার কথায়, ইসরায়েলি হামলা তাদের সামর্থ্য ও উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, গত সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে ইরান যে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, তার বেশিরভাগই প্রতিহত করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে একটি বা দুটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং ক্ষতিসাধন করেছে। ইরানি কর্মকর্তারা এ হামলাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ইসরায়েল যে ইরানের পুরোনো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সফল হয়েছে, সেটা প্রচার হয়ে যাবার বিষয়টি চায় না ইরান। তিনি বলেন, সামরিকভাবে ইরানের চেয়ে ইসরায়েল অনেক এগিয়ে। এটা তারই প্রমাণ। তার মতে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যাওয়ার থেকে নিজেদের চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোও প্রক্সি ব্যবহার করে ছায়াযুদ্ধ করতে বেশি পছন্দ করবে ইরান।

রাশিয়ার ভূমিকা কী : ইরানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে রাশিয়া। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত শুক্রবার ইসরায়েলকে বলেছেন, ইরান এ বিবাদটিকে আর বেশি বাড়াতে চায় না। রাশিয়া ও ইরানের নেতৃত্ব আমাদের প্রতিনিধি এবং ইসরায়েলিদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে রাশিয়ান রেডিওকে জানিয়েছেন মি. ল্যাভরভ। তার কথায়, এ আলোচনায় আমরা এটা খুব স্পষ্ট করে ইসরায়েলিদের বলেছি, ইরান উত্তেজনা বাড়াতে চায় না। ওদিকে মি. ব্রেটন-গর্ডন বলছেন, গত সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ইরান কিছু সাফল্য এনেছিল। তবে তারা আর এগোতে চায় না। গত পহেলা এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানের বাণিজ্য দূতাবাসে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ওই হামলা চালিয়েছিল ইরান। তিনি বলেন, ইরান জানে, ইসরায়েল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সমর্থনও আছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য সাহায্যের ওপর খুব বেশি ভরসা করতে পারছে না ইরান। এ ছাড়া তারা কিছুটা একাও হয়ে গেছে।