ঘর শীতল রাখার চীনা প্রাচীন কৌশল
বাষ্পীভবন শীতল প্রক্রিয়ার ফলে ঘরের আঙিনার গড় তাপমাত্রা বাইরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি থেকে ৪ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায়
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
রু লিং চীনের পুরোনো বাড়িগুলোর ভেতরে থাকা ফাঁকা জায়গা বা উঠানে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। তার জন্য এই জায়গাগুলো গরম এবং আর্দ্র দিনের জন্য উপযুক্ত। এ স্থানগুলোয় প্রচুর বাতাস চলাচল করে, জায়গাটি শীতল এবং ছায়া দেয়। চীনের পূর্বাঞ্চলে আনহুই প্রদেশের গুয়ানলু গ্রামে ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ৭ বছর রু প্রায় শত বছরের পুরোনো একটি প্রাচীন কাঠের বাড়িতে থাকতেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনে বহু বছর বসবাস ও কাজ করার পর তিনি তার জীবন পরিবর্তন করতে এ বাড়িতে চলে আসেন। গ্রীষ্মে এ বাড়িতে প্রাকৃতিকভাবে শীতলতার অনুভূতি পাওয়া যায়; যা খুব সতেজ করে দেয়। এ অনুভূতি আধুনিক বিশ্বে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ বাড়িটিতে ধ্যান করার মতো আরামদায়ক পরিবেশও আছে। এ বাড়ির ভেতরে যে আঙিনা বা উঠোন রয়েছে, সেটা এ শীতল প্রভাব তৈরি করতে সাহায্য করেছে। গরম আবহাওয়ায় বাড়ির উঠোনের সুবিধাগুলো শুধু তিনিই উপভোগ করছেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ চীনের কিছু বাড়ির উঠোনের ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম, ৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম। আজ চীন দ্রুত নগরায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন যেসব বাড়িগুলোয় ভেতরে এমন ফাঁকা জায়গা বা উঠোন রয়েছে, সেখানে অনেক কম লোক বাস করে। এখন বহুতল ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্ট এবং অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো আবাসনের প্রধান রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যের প্রতি নতুন করে আগ্রহ জাগার ফলে কিছু ঐতিহাসিক ভবনের ভেতরের আঙিনা আধুনিক সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সরকার নির্মাণ খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোকে উৎসাহিত করছে। এখনকার স্থপতিরা নতুন নির্মিত ভবনগুলো শীতল রাখার চেষ্টা করছে। এমন খোলা জায়গা রাখার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে।
তাপের জন্য ফায়ারপ্লেস : বাড়ির ভেতরের আঙিনা, যাকে ম্যান্ডারিন ভাষায় তিয়ান জং বলা হয়, এটি দক্ষিণ এবং পূর্ব চীনের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তবে তিয়ান জং দেশটির উত্তরের বাড়িগুলোয় থাকা সাধারণ খোলা আঙিনা বা ইউয়ান জি থেকে আলাদা। কারণ, ইউয়ান জি বাড়ির বাইরে আলাদা খোলা পরিবেশে যা আরো বড় এবং আরো বেশি উন্মুক্ত হয়ে থাকে।
মিং (১৩৬৮-১৬৪৪) এবং কিং (১৬৪৪-১৯১১) রাজবংশের আমলে নির্মিত স্থাপনাগুলোয় বাড়ির ভেতরের আঙিনা রাখা একটা সাধারণ বিষয় ছিল। মূলত পরিবারের কয়েক প্রজন্ম ধরে এ আঙিনা ডিজাইন করা হয়েছে। ২০১০ সালে চীনের নানচাং বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে প্রকাশিত এক নথি থেকে এসব তথ্য জানা যায়। বাড়ির ভেতরের এসব উঠানের আকার এবং নকশা একেক অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত হয়। তবে এ খালি জায়গাটি প্রায় সবসময় আয়তকার হয়ে থাকে এবং এর অবস্থান থাকে বাড়ির কেন্দ্রে। উঠানের চারদিক বা তিনদিক কক্ষ ও প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত থাকে। কিছু বড় বড় বাড়িতে একাধিক উঠোন থাকে। সিচুয়ান, জিয়াংসু, আনহুই এবং জিয়াংজি প্রদেশের মতো দক্ষিণ ও পূর্ব চীনের বেশিরভাগ অঞ্চলের ঐতিহাসিক বাড়িগুলোয় ভেতরে উঠোন থাকা তুলনামূলকভাবে সাধারণ বিষয়। মধ্য-পূর্ব চীনে গুয়াংদং প্রদেশের ঐতিহাসিক শহর হুইঝোতে কিছু সেরা-সংরক্ষিত উঠোন পাওয়া গেছে, যা বর্তমান আনহুই এবং জিয়াংসি প্রদেশের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের অনেক আগে ভবনকে শীতল রাখতে অভ্যন্তরীণ আঙিনাগুলো ডিজাইন করা হতো। যখন একটি বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়, তখন এই খালি জায়গার মাধ্যমে বাতাস সারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। যেহেতু বাইরের বাতাস সাধারণত ভেতরের বাতাসের চেয়ে ঠান্ডা থাকে, তাই বাইরের ঠান্ডা বাতাস দেওয়ালের মধ্য দিয়ে প্রতিটি তলায় চলে যায়। যার ফলে ভেতরের উষ্ণ বাতাসকে সরিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ তৈরি হয়। তখন ভেতরের গরম বাতাস ঘরের ওপরের দিকে উঠে ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
পানির প্রভাব : বাড়ির ভেতরের আর বাইরের পরিবেশের মধ্যে বাতাস স্থানান্তর স্থান হিসেবে কাজ করে এই উঠোন। বাইরের গরম বাতাস থেকে বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্য এই উঠোন একটি দক্ষ থারমাল প্রটেক্টর বা তাপ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই উঠোনে শীতল প্রভাবের তখনই ঘটে, যখন সেখানে কোনো জলাশয় থাকে। পানি বাষ্পীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি গরম বাতাসকে শীতল করে। এটি বাষ্পীভূত শীতল প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচিত এবং হুইঝো-এর অভ্যন্তরীণ আঙিনায় এই প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। অতীতে, হুইঝো শহরে থাকা পরিবারগুলো তাদের উঠোনে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করত। কারণ, তারা বিশ্বাস করত যে, এই পানি সংগ্রহের ফলে তাদের সম্পদ রক্ষা পাবে এবং সম্পদ বাড়বে। এ কারণে ছাদ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ভেতরের উঠোনগুলোর চারপাশে চ্যানেল রাখা হতো। কিছু ধনী পরিবার তাদের আঙিনার মাটি খনন করে এমন নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন করেছিল, যাতে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ প্রবেশদ্বারকে ঘিরে ফেলার পরই বেরিয়ে যেতে পারে।
হুইঝো শহরের বাড়িগুলোয় ভেতরের উঠোনের মাঝখানে একটি বড় পাথরের বেসিন রয়েছে; যা প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য পানি সঞ্চয় করে এবং আগুন ধরলে এই পানি দিয়ে যেন নেভানো যায়। হুইঝু-এর দুটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামে আঙিনা থাকা বাড়িগুলো নিয়ে ২০২১ সালে একটি সমীক্ষা হয়। সেখান থেকে জানা যায়, বাষ্পীভবন শীতল প্রক্রিয়ার ফলে ঘরের আঙিনার গড় তাপমাত্রা বাইরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি থেকে চার দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায়।
সবুজ প্রযুক্তি : বর্তমানে আধুনিক ভবনগুলোয় খালি জায়গা ফিরে আসার ক্ষেত্রে সরকারি বিধি-বিধানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৩ সাল থেকে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার সবুজ ভবন নির্মাণে উৎসাহ দিয়ে আসছে। যা সম্পদ সংরক্ষণ করছে এবং মানুষের নিয়মিত জীবনে দূষণের মাত্রা কমে আসছে। ২০১৯ সালের একটি সরকারি নির্দেশনায় ২০২২ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভবনে খোলা জায়গা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেন তারা সবুজ মান অর্জন করতে পারে। এ সবুজ মান অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট মানদ- রয়েছে। যেমন- তাপ নিয়ন্ত্রণের গুণমান এবং নির্মাণ সামগ্রীর পরিবেশগত মান রক্ষা করা।
স্থপতিরা এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা মাথায় রেখে নতুন ভবন ডিজাইন করছে এবং সেখানে খালি জায়গা রাখার সুবিধাগুলো পরীক্ষা করছেন। পূর্ব চীনের জিনান শহরের ন্যাশনাল হেভি ভেহিকল ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার এর একটি উদাহরণ। ১৮ তলাসম্পন্ন কাচের দেওয়ালে তৈরি এই টাওয়ারটির কাজ ২০২২ সালে শেষ হয়েছিল। এই ভবনের মাঝখানে একটি বিশাল খালি জায়গা রয়েছে; যা পঞ্চম তলা থেকে একদম মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত। সাংহাইভিত্তিক সিসিডিআই গ্রুপের স্থপতিদের মতে, সব লিফট, টয়লেট এবং মিটিং রুম এই ফাঁকা জায়গার চারপাশে অবস্থিত; যা ভবনের ভেতরে প্রাকৃতিক আলো এবং বায়ু চলাচল বাড়াতে সাহায্য করেছে। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। হুইঝো অঞ্চলের জুয়ানচেং-এর জিক্সি জেলার পুরোনো টাউন হল ভবনটি ২০১৩ সালে সংস্কার করা হয়েছিল এবং ভবনটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। হুইঝো স্থাপত্যশৈলির আদলে এই কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর ভেতরে বেশ কয়েকটি খালি জায়গা রাখা হয়েছে। এর পেছনে যারা কাজ করেছেন, তাদের মতে এই ফাঁকা জায়গা রাখার ফলে কমপ্লেক্সের ভেতরে বায়ু সরবরাহ করতে পারছে।