ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিমানযাত্রায় হজ কাফেলার বিবর্তন যেভাবে

হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
বিমানযাত্রায় হজ কাফেলার বিবর্তন যেভাবে

এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর আগে শরতের একদিনে মুঘল শাহজাদী গুলবদন বেগম হজ পালনের জন্য পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। রাজপরিবারের একদল নারী হজ যাত্রীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন গুলবদন বেগম। তিনি ছিলেন ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম নারী, যিনি হজে গিয়েছিলেন। গুলবদন বেগম ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের কন্যা। তিনি যখন হজে যাচ্ছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৫৪ বছর। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে হজে যাওয়ার ইতিহাস আরো পুরোনো। বর্তমানে বাংলাদেশের যে ভূখণ্ড, সেখান থেকেও হজে যাওয়ার ইতিহাস সুলতানি আমল থেকে। যার গোড়াপত্তন হয়েছিল ১২০৪ সালে। মূলত ওই সময় থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। ইতিহাসবিদদের ভাষ্যমতে, সুলতানি আমল থেকে পালতোলা জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজ যাত্রী পরিবহনের ইতিহাস রয়েছে।

উত্তাল সমুদ্র যাত্রা : হজ যাত্রা শুরুতে বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে হজ পালন করতে গিয়েছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, লেখক ও দানবীর খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ। হজে যাওয়ার স্মৃতি তিনি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। তিনি কবে হজে গিয়েছিলেন, সেটির দিন-তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। তবে তার লেখা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, হজে যাওয়ার সময়কাল ১৯২০ সালের পরে হতে পারে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ লিখেছেন, হজে যাওয়ার জন্য তিনি প্রথমে কলকাতা যান। তারপর কলকাতা থেকে এলাহাবাদ পৌঁছান। এলাহাবাদ থেকে ট্রেনে করে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বাই) যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সেখান থেকে হজের জাহাজে উঠবেন। কিন্তু বোম্বেতে তখন প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সেজন্য মুম্বাই না গিয়ে তারা করাচি বন্দরে যান। করাচি গিয়ে তাদের জাহাজের জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। সমুদ্রপথে যাত্রা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ ছিল, অন্যদিকে সেটি বেশ ভয়ঙ্করও ছিল। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর লেখা ‘আমার জীবনধারা’ বইয়ে সেটির বর্ণনা পাওয়া যায়। জাহাজে করে যাওয়ার সময় তারা সঙ্গে চাল-ডাল, লবণ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে উঠেছিলেন। কারণ, জাহাজে তারা নিজেরাই রান্না করতেন।

চট্টগ্রামবন্দর থেকে হজ যাত্রা শুরু : ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারিভাবে চট্টগ্রামবন্দর দিয়ে সাগরপথে হজ যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। সেজন্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে একটি স্থায়ী হাজী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব হাজী চট্টগ্রামবন্দর দিয়ে হজে যাতায়াত করত। অল্প কিছু সচ্ছল হাজি ঢাকা থেকে করাচিতে বিমানে করে যেত। তারপর সেখান থেকে হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করত। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকেও প্রতি জাহাজে দুটি ট্রিপ করে চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা হাজী পরিবহন করা হতো। প্রথম ট্রিপ ছাড়ত রোজার ঈদের সাতদিন পরে। সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের হাজীরা ঈদের পরদিন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে গিয়ে ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। দুটি জাহাজে প্রায় ২ হাজার ৬০০ হজ যাত্রী পরিবহন করা হতো। তখন ছফিনা-এ-আরব এবং ছফিনা-এ-আরাফাত নামের দুটি জাহাজ চলাচল করত। তখন করাচি থেকে জেদ্দায় বিমানে করে হজ যাত্রীদের নেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হতো। তৎকালীন ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজের এ রকম একটি বিজ্ঞাপন ফেসবুকে অনেকে শেয়ার করেন বিভিন্ন সময়। সে বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, করাচি হইতে জেদ্দা পৌঁছিতে ওরিয়েন্টের দ্রুত ও আরামদায়ক বিমানে মাত্র ৯ ঘণ্টা লাগে। ভাড়া ১১৫০ টাকা। ইসলাম ও ভ্রমণবিষয়ক লেখক আহমাদুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ সুন্দর ব্যবস্থাটি চট্টগ্রামবন্দরে বজায় ছিল। তখন ডেক তথা তৃতীয় শ্রেণিতে ভাড়া পড়ত ১৯১৯ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার টাকা সৌদি আরবে থাকাণ্ডখাওয়া খরচ এবং ৯১৯ টাকা জাহাজে খাওয়া ও ভাড়া এবং অন্যান্য সরকারি খরচ। জাহাজে দ্বিতীয় শ্রেণিতে যাতায়াত করলে সবমিলিয়ে খরচ হতো ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া প্রথম শ্রেণিতে সর্বমোট খরচ হতো ৭ হাজার টাকার কিছু বেশি। করাচির মুহাম্মদ রমজান ১৯৭৪ সালে জাহাজে করে হজে গিয়েছিলেন। হজে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে রমজান ২০২০ সালে আরব নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি ৬ হাজার রুপি দিয়ে জাহাজের টিকিট ক্রয় করেছিলাম। তখন জাহাজে করে করাচি থেকে জেদ্দা পৌঁছাতে ৭ দিন সাতরাত জাহাজে ছিলেন।

স্বাধীনতার পরে হজ : ৯ মাস যুদ্ধের অবসানে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর হজ নিয়ে ভিন্ন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলে বাংলাদেশি হিসেবে হজে যাওয়া যাচ্ছিল না। সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি সৌদি আরব মানতে পারেনি। ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তৎকালীন বাংলাদেশিদের ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে হজে যেতে হয়েছিল। ভারতীয় মুহাম্মদী জাহাজে করে চট্টগ্রামবন্দর থেকে হজ যাত্রী পরিবহন করা হয়। অন্যদিকে লটারির মাধ্যমে তিন হাজার হজ যাত্রী বাছাই করে তাদের বিমানযোগে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়। ভারতীয় জাহাজটি ছিল বেশ পুরোনো ও দুর্বল। ফলে সমুদ্রপথে যাতায়াতের উপযোগী ছিল না। সেজন্য সেটি বাদ দিয়ে ১৯৭৭ সালে একটি জাহাজ ক্রয় করে বাংলাদেশ সরকার। যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘হিজবুল বাহার’। ধীরে ধীরে ঢাকা থেকে হজ ফ্লাইট বাড়তে থাকে এবং এখানে নানা ধরনের প্রশাসনিক কাজ শুরু হয়।

শেখ মুজিব-বাদশাহ ফয়সাল বৈঠক : ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের হজ পালনের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয় সে তারবার্তায়। এটি তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মভীরু মুসলমান এবং তাহারা কঠোরভাবে ইসলামের অনুশাসন পালন করিয়া থাকে।’ সে তারবার্তায় বলা হয়েছিল। ‘ভিসা মঞ্জুর করার জন্য আপনার সরকার যদি কোনো অফিসার প্রেরণ করিতে চান, তাহা হইলে তাহাকে সাদরে গ্রহণ করা হইবে এবং সকল সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হইবে।’ ১৯৭৩ সালে আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায় আয়োজিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। তখনও পাকিস্তান ও চীনের পাশাপাশি সৌদি আরব ও লিবিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। আলজিয়ার্সে পৌঁছে শেখ মুজিবুর রহমান কর্নেল গাদ্দাফি এবং সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশকে সৌদি আরব ও লিবিয়া কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না, সেটি জানতে চান শেখ মুজিব। কিন্তু এ বৈঠক আয়োজন করা খুব একটা সহজ ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের অক্লান্ত চেষ্টায় আলজিয়ার্সে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী হিসেবে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল। তার লেখা ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইয়ে মুকুল শেখ মুজিবুর রহমান ও বাদশাহ ফয়সালের মধ্যে বৈঠকের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু মুজিব ও বাদশাহ ফয়সালের মধ্যে সেই বৈঠক ফলপ্রসূ ছিল না। শেখ মুজিব জানতে চান, ইন্দোনেশিয়ার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হয়েও সৌদি আরব কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। কারণ, সৌদি আরব স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের হজে যেতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। এজন্য সৌদি বাদশাহ শেখ মুজিবকে দুটি শর্ত দেন। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ রাখা। অন্যটি হচ্ছে, অবিলম্বে সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু এসব ব্যাপারে শেখ মুজিব একমত হতে পারেননি। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাদশাহ ফয়সালের একটি ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, অবশেষে একটি বৈঠকের পর বাংলাদেশিরা হজ পালনের অনুমতি পায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত