গাজার তিনটি হাসপাতাল অবরুদ্ধ করে ইসরায়েলি বাহিনী অভিযান চালায়। এর কয়েক মাস পর এগুলোর চারপাশে গণকবরের সন্ধানে কাজ করে ফিলিস্তিনের জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীরা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের কমান্ড সেন্টার হিসেবে এসব হাসপাতাল ব্যবহৃত হতো বলে দাবি করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজার বিভিন্ন গণকবরে পাঁচ শতাধিক মানুষের মরদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে। এসব মরদেহের কোনো কোনোটিতে অঙ্গচ্ছেদ ও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। ইসরায়েল গাজায় যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, এগুলো তার প্রমাণ। অবশ্য ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী যুদ্ধাপরাধের এমন অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, হামাস ও ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে ওইসব এলাকায় লড়াইয়ে নিহত হয়েছিলেন এসব ব্যক্তি। পরে ফিলিস্তিনিরা তাদের দাফন করেন।
প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা অসম্ভব : এ নিয়ে সত্য উদ্ঘাটন ও দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেন, ‘সব ফরেনসিক প্রমাণ ভালোভাবে সংরক্ষণ করাটা জরুরি।’ কিন্তু গাজার সর্ব দক্ষিণের ও অতি ঘনবসতিপূর্ণ শহর রাফায় হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল। বন্ধ করে দিয়েছে মিসরের সঙ্গে গাজার সীমান্ত ক্রসিং। এতে এ উপত্যকায় ফরেনসিক দল পাঠানো বা গণকবরের সন্ধান চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর দাফনের স্থানগুলোয় চলছে এলোমেলো খোঁড়াখুঁড়ি ও প্রমাণ সংগ্রহের কাজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে এমন সব স্থানে এ রকম প্রতিবন্ধকতা সত্যের সন্ধান পাওয়াকে কঠিন করে তুলবে। তবে এ ঘটনায় ন্যায়বিচার পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে যাবে, তা নয়।
গণকবর থেকে প্রমাণ সংগ্রহ : খান ইউনিস শহরে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে তিনটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনটি পাওয়া গেছে গাজা সিটির আশ শিফা হাসপাতালে ও বেইত লাহিয়ার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে একটি। গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য মোহাম্মদ জানিন বলেন, আশ শিফা হাসপাতালে চতুর্থ আরেকটি গণকবর পাওয়া গেছে। সেখানে ৪২ জনের মরদেহ রয়েছে। মরদেহগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে কারও কারও সঙ্গে পাওয়া গেছে পরিচয়পত্র ও কাউকে কাউকে তাদের স্বজনরা পোশাকের নমুনা দেখে চিহ্নিত করেছেন। মোহাম্মদ জানিন বলেন, ছবি তুলে ও ভিডিও করে এসব মরদেহের ব্যাপারে তথ্য নথিভুক্ত করে রাখছেন বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে আছে সামান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম। অবশ্য কোনো ফরেনসিক উপকরণ নেই। তিনি বলেন, ‘মরদেহ রাখার জন্য আমাদের কাছে কিছু ব্যাগ আছে। হাত ও নাকের সুরক্ষায় আছে সামান্য কিছু সরঞ্জাম। বাস্তবতা হলো, আমরা যা করছি, তা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের পদক্ষেপ। আমাদের কর্মীরা আছেন অনেক চাপের মুখে।’ থানি নিমর আবদুর রহমান গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ‘আল মিজান ফর হিউম্যান রাইটস’ নামের সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেন। আশ শিফা হাসপাতালের গণকবরগুলো পরিদর্শন করেছেন তিনি। বলেছেন, বুলডোজার ব্যবহার করে গণকবরগুলো খোঁড়া হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ মিলল কি না : বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য গণকবর দেওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন করাসহ তাদের সঙ্গে নানা ধরনের দুর্ব্যবহার, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা ও বেসামরিক লোকজনকে বেআইনিভাবে হত্যার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছেন; যা যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে। আশ শিফা হাসপাতালে গণকবর খোঁড়ায় অংশ নেওয়া বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের একজন রামি দাবাবেশ। তিনি বলেন, তার দল মস্তকবিচ্ছিন্ন কিছু মরদেহ দেখেছেন। এ ছাড়া হাসপাতালের পোশাক পরা শিশু ও নারীদের মরদেহ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী আদেল আল মাশারাবি। বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর আরেকজন সদস্য মোহাম্মদ মুগির বলেন, অন্তত ১০ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে, যাদের হাত ছিল বাঁধা। অন্যদের শরীরে লাগানো ছিল রোগীদের জন্য ব্যবহার করা নল। তিনি বলেন, প্রায় ২০টি মরদেহের ক্ষেত্রে বাড়তি ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাদের ধারণা, এ ব্যক্তিদের জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে কিছু মরদেহ পাওয়া গেছে, যেগুলো ছিল স্তূপীকৃত অবস্থায়। এতে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এ ব্যক্তিদের উন্মুক্ত স্থানে মেরে এখানে জড়ো করে কবর দেওয়া হয়েছে। শুধু এ স্থানেই কমপক্ষে ৩৯২ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এসব প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না, গণকবর নিয়ে তদন্তের কাজ করা সাধারণত খুব জটিল, দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট দক্ষতা ও উপকরণের। এ ক্ষেত্রে সংগৃহীত মরদেহ বা নমুনার কোনো ক্ষতি করা যায় না।
গণকবর নিয়ে তদন্তে বিশেষ অভিজ্ঞতা : ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক বিজ্ঞানী স্টেফান স্মিটের। তিনি বলেন, বিশেষত আগ্রাসী পদ্ধতি, যেমন মৃতদেহের সন্ধানে বুলডোজার দিয়ে গণকবর খোঁড়া হলে এমন সব সূত্র নষ্ট হয়, যা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নির্ধারণে সহায়তা করতে পারত। এসব সূত্র দিয়েই উদ্ঘাটন করা যায়, কবে ও কোন উপকরণ ব্যবহার করে গণকবর দেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়। আবার মরদেহের ময়নাতদন্ত ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শির- েদ করা বা জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো দাবি সমর্থন করাও কঠিন বলে এ ফরেনসিক বিজ্ঞানী জানান। তিনি বলেন, প্রমাণ হিসেবে শুধু মরদেহের ছবি বা ভিডিও হাজির করাটা সন্দেহ নিরসনে যথেষ্ট নাও হতে পারে।
সহায়তা করতে পারবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো : গাজায় গণকবরগুলো নিয়ে ‘একটি স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের’ আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ আহ্বান সমর্থন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, হাসপাতালগুলোতে মরদেহের এ সন্ধান সেখানে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করার ধারণা দেয়। আর যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত চায় তারা। কোন সংস্থা এসব আহ্বানে সাড়া দেবে কিংবা ভবিষ্যতে কে-ই বা তদন্তের বিরাট কাজ গ্রহণ করতে পারে, তা স্পষ্ট নয়। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স বলেন, ‘গাজায় গণকবরের স্থান থেকে প্রমাণ সংগ্রহে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহায়তা দিচ্ছে না। কেন না, এ জন্য নির্দিষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন; যা বাস্তবিক অর্থে সংস্থাগুলোর নেই।’
ন্যায়বিচারের আশা কতদূর : গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে আইনি পদক্ষেপ চলমান। ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও এরপর থেকে গাজায় চলা ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতার ওপর একটি তদন্তের দেখভাল করছেন হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তদন্তকাজ চালানোর এখতিয়ার আইসিসির প্রধান কৌঁসুলির দপ্তরের রয়েছে। তবে গাজায় গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর এ বিষয়ে দপ্তর থেকে প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
এদিকে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা একটি মামলা খতিয়ে দেখছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। অবশ্য এ নিয়ে কোনো রায় পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।