গত কয়েক মাস গাজায় সংঘাত ও মানুষের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। সেইসঙ্গে গাজার পশ্চিম তীরেও ক্রমশ সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব রাষ্ট্র লাভের দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। একাধিক ইউরোপিয়ান দেশের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারবে না যে, এটি করার জন্য আরো অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিতে হবে। অর্থাৎ কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি সেই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু মঙ্গলবার তিন ইউরোপীয় দেশ- স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে যেহেতু ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, তাদের এ সিদ্ধান্ত ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর ওপর বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির ওপর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার জন্য এক ধরনের পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করবে।
একজন আরব কূটনীতিক বলেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলি সরকারের কারও বারণ শুনতে অস্বীকৃতি জানানোর বিষয়টি নিয়ে ইউরোপিয়ান হতাশাই প্রতিফলিত করে ওই সিদ্ধান্ত। তাদের এ সিদ্ধান্ত সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চাপের মুখে ফেলছে।’ তবে ইসরায়েলের মন্ত্রীরা জোর দিয়ে বলেছেন, এটি হামাসকে আরো বেশি উৎসাহিত করবে এবং সন্ত্রাসবাদকে স্বাগত জানাবে। এমনকি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিষ্পত্তির সম্ভাবনা আরও হ্রাস করবে। এর আগে প্রায় ১৩৯টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
চলতি বছরের ১০ মে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে ১৪৩টি দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে, যাতে দেশটি জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করতে পারে। ফিলিস্তিন ২০১২ সাল থেকেই জাতিসংঘের অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে। এতে করে দেশটি একটি আসন পেলেও পূর্ণ সদস্য হওয়ার সুযোগ-সুবিধা পায় না। যেমন- সভায় ভোটাধিকার। তবে এটি আরব লীগ ও অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে স্বীকৃত। ইউরোপের সংখ্যালঘু দেশগুলো এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে ১৯৮৮ সালেই হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস ও মাল্টা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ওই সময়েই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চাওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরো আছে সুইডেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ২০১৪ সালে এ স্বীকৃতি দিয়েছিল।
তবে অনেক ইউরোপীয় দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে আলাদা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তারা বলছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি একটি রাজনৈতিক সমাধানের অংশ হিসেবে তারা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। এটিকে প্রায়ই ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’ (টু-স্টেট সলিউশন) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিল ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে। যেখানে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি উভয়েই তাদের নিজস্ব সীমানাসহ নিজস্ব রাষ্ট্রের বিষয়ে সম্মত হয়েছিল। অবশ্য ফিলিস্তিনকে কখন স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ে বলেছে, তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটি করছে। তাদের যুক্তি হলো, উভয় পক্ষই যদি একই ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করে, তাহলে বর্তমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান হবে। তবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরো সমর্থন প্রদর্শন করার জন্য এ দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপও সামাল দিতে হচ্ছে। আগে অনেক পশ্চিমা দেশের অবস্থান ছিল, চূড়ান্ত শান্তি চুক্তির ফলাফল হিসেবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ গত কয়েক মাসের মধ্যে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তারা বলছে, রাজনৈতিক মীমাংসাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহায়তা করতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আগে আসতে পারে।
ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ফ্রান্সের জন্য নিষিদ্ধ নয়।’ ওই মাসের শুরুতে সাধারণ পরিষদের ভোটে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ সমর্থন করেছিল ফ্রান্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে গোপনে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা আসলে পরিষ্কার হতে চায় যে, তাদের এ নীতির ফলাফল বাস্তবে কী হতে পারে! সুতরাং এত কিছুর পেছনে মূল বিতর্কের জায়গাটি হলো, এ দেশগুলোর কখন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ, কখন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক শান্তি আলোচনা শুরু হয়, কখন ইসরায়েল ও সৌদি আরব তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, কখন ইসরায়েল সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় বা কখন ফিলিস্তিনিরা কিছু পদক্ষেপ নেয়। অন্যভাবে বললে, তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চায়। কিন্তু তারা এটিকে তাদের কূটনৈতিক সাফল্যের একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখতে চায়।
একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একটি বড় কার্ড, যা পশ্চিমা দেশগুলোকে খেলতে হবে। আমরা এটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই না।’ তবে সমস্যা হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া কেবলই একটি প্রতীকি বিষয়। এর কূটনৈতিক গুরুত্ব আছে, কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর না পেলে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতিতে বদল আসবে না। যেমন- ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সীমানা কী হওয়া উচিত? রাজধানী কোথায় হবে? এটি বাস্তবায়ন করার জন্য উভয় পক্ষের সর্বপ্রথম কোনো কাজ করা উচিত? এগুলো সব কঠিন প্রশ্ন, কয়েক দশক ধরেও যার সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ইউরোপের আরো কিছু দেশ বিশ্বাস করে যে, একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হওয়া উচিত। সমর্থকরা এ বিষয়টিতে উল্লাস করবে, বিরোধীরা এর নিন্দা করবে। বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের ভয়াবহ বাস্তবতা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।