মুসলমানরা ইসলামি আইন চর্চা করতে গিয়ে গণিতের দুটি নতুন শাখা উদ্ভাবন করেছেন- এক. সম্পত্তি (মিরাস) হিসাবের জন্য বীজগণিত, দুই. নামাজের সময় নির্ধারণ করতে ত্রিকোণমিতি। সম্পত্তি বণ্টনে ব্যবহার করা হয় সমীকরণ আর সূর্যের আলোছায়া মেপে তারা ঠিক করতেন নামাজের ওয়াক্ত। এখন হয়তো বিজ্ঞানের অনেক শাখাই বীজগণিত ছাড়া কল্পনা করা যায় না, ভূতত্ত্ব-মহাকাশবিদ্যায় ত্রিকোণমিতি জরুরি। মুসলমানরা এমন হাজারো আবিষ্কার বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। যা ইতিহাসের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন গণিতশাস্ত্রে অসাধারণ অবদান রাখা মধ্য এশিয়ার মুসলিম বিজ্ঞানী আল খাওয়ারিজমি।
জন্ম ও শৈশব-কৈশোর : আল খাওয়ারিজমি হলেন মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ও কীর্তিমান বিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন একাধারে ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও দার্শনিক। তার পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃত করে রাখা হয় ‘এলগোরিজম’ (Algorism)। তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়া নদীর একটি দ্বীপের কাছে অবস্থিত খাওয়ারিজম নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এর অবস্থান ছিল পারস্যের অন্তর্গত খিভা (বর্তমানে উজবেকিস্তানের জোরাজম) প্রদেশে। এ শহরটি প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। যার তৎকালীন নাম ছিল উরগেঞ্চ। তার জন্মতারিখ বা শৈশব-কৈশোর সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ফিকহ চর্চাকালে অনন্য আবিষ্কার : তার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য যেহেতু অপ্রতুল ও তিনি একজন মুসলিম বিজ্ঞানী, সেহেতু তার বিশ্ববিখ্যাত গাণিতিক দুটি বৈজ্ঞানিক অবদান, যা তিনি ফিকহ চর্চা করার সময় আবিষ্কার করেছেন। তা সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত করা হলো-
এক. বীজগণিত : বীজগণিত হলো ইসলামি সভ্যতায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। এ ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষতা লাভ করেন। তার হাতেই গণিতের এ শাখাটি পরবর্তী সময়ে আরো সমৃদ্ধশালী হয়। বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিতবিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে, তার মূলে রয়েছে আল খাওয়ারিজমির উদ্ভাবিত গণিত বিষয়ক নীতিমালার বেশি অবদান। তার রচিত বই ‘আল কিতাব আল মুখতার আল হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ বা ‘দ্য কম্পেন্ডিয়াস বুক অন ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লেশন অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’ হতে বীজগণিতের ইংরেজি নাম অ্যালজেবরা (Algebra) উৎপত্তি লাভ করে। এর মূল কপি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। Algorithm শব্দটি অষশযধিৎরুসর নামের ল্যাটিন algorismi হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অ্যালজেবরায় লিনিয়ার বা একঘাত এবং কোয়াড্রেটিক বা দ্বিঘাত সমীকরণ আছে। আমরা সাধারণত কোনো সমীকরণ সমাধান করে যখন- ী অথবা ু-এর একটি করে মান পাই। যেগুলো একঘাত সমীকরণ নামে পরিচিত। আবার দ্বিঘাত সমীকরণে দুটি মান পাওয়া যায়। তার অ্যালজেবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণিত জগতে এর উপযোগিতা অভাবনীয় বেড়ে যায়। মধ্যযুগের আর কোনো গণিতবিদই গণিত জগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি। তিনি গণিতের এলগোরিদম শাখাটিও উন্নয়ন করেন।
দুই. ত্রিকোণমিতি : ইসলামি সভ্যতায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ আরেকটি অবদান হলো ত্রিকোণমিতি। সমকোণী ত্রিভুজের তিন কোণ আর বাহু নিয়ে ত্রিকোণমিতির কারবার। আল খাওয়ারিজমি উদ্ভাবন করেন ত্রিকোণমিতির বিস্তারিত উপাত্ত। তিনিই কনিক সেকশনের গাণিতিক ধরনের আধুনিকায়ন করেন। এরপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন ক্যালকুলাসে। তিনি ক্যালকুলাসের উন্নয়ন ঘটির আধুনিকায়ন করেন। ডিফারেনিয়াল ক্যালকুলাস হচ্ছে এর একটি শাখা। সূর্যের আলোছায়া মেপে ঠিক করতেন নামাজের ওয়াক্ত। মূলত ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে চন্দ্র ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত হিসাব করা যায়। এ ছাড়া তার বিশ্বকাঁপানো উল্লেখযোগ্য বেশকিছু শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
১. পাটি গণিত : এ বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন। যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে হিন্দু গণিতবিদরা দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতিকে খাওয়ারিজমিই প্রথম ইসলামি জগতে নিয়ে আসেন। তার রচিত The Book of Addition and Substraction According to the Hindu Calculation (যোগ-বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) তারই উদাহরণ।
২. গণিতে শূন্যের ব্যবহার (দশমিক) : এটিও গণিতের অন্তর্ভুক্ত। তাই এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হলো। গ্রীক ও ভারতীয় হিন্দু গণিতবিদদের মধ্যে গণিতের যে অসম্পূর্ণতা ছিল, সে অসম্পূর্ণতা দূর করেছিলেন আল খাওয়ারিজমি। তার গণিতের উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ ও অনন্য। আরবীয়রা ভারতীয়দের কাছ থেকে সংখ্যা লিখন প্রণালি শিক্ষা লাভ করেন। মুসলমান বৈজ্ঞানিকরা পরে এটিকে সংশোধন করেন। শূন্য লিখন প্রণালি উদ্ভাবন করেন। খাওয়ারিজমি এ শূন্য লিখন প্রণালিকে সর্বশেষ রূপদান করেন। ইউরোপীয়রা মুক্তকণ্ঠে এ কথা স্বীকার করেন। এ শূন্য ব্যবহার করার ফলে গণিত এসে দাঁড়াল পরিপূর্ণ প্রেক্ষিতে। এ শূন্য ব্যবহার গণিতে নিয়ে এলো এক অসাধারণ বিপ্লব।
৩. ভগ্নাংশ পদ্ধতি : এটি ইসলামি ফারায়েজ (সম্পত্তি বণ্টন)-এর ক্ষেত্রে বহু ব্যবহার হয়ে থাকে। ভারতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার সময় তিনি আবিষ্কার করেন ভগ্নাংশের বিস্ময়কর দিক। তার এ কাজগুলো পরিচিত ছিল আরব্য-কর্ম হিসেবে। শিগগিরই তার কর্মণ্ডঅবদানগুলো পৌঁছে গেল ইউরোপে। ইউরোপীয়রা দ্রুত তার বই ও লেখাগুলো অনুবাদ করে নেয়। সেই সঙ্গে তিনি ইউরোপেও বিখ্যাত হয়ে যান। তিনি দশমিক ব্যবস্থাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে চাইলেন। এ ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়।
৪. জ্যামিতি : তিনি প্রথম বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন। জ্যামিতির ক্ষেত্রে আয়ত, বর্গ, ত্রিভুজ ইত্যাদি জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলোর যে ধারণা দিয়েছিলেন, তা হুবহু আজও একই রকম রয়েছে। তিনিই কনিক সেকশনের গাণিতিক ধরনের আধুনিকায়ন করেন।
৫. জ্যোতির্বিদ্যা : এ ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য এবং দিয়ে গেছেন নতুন ধারণা প্রজ্ঞার জগতে। তার আরো কাজের মধ্যে ঘড়ি ও সূর্যঘড়ির ক্ষেত্রে অবদান অন্তর্ভুক্ত। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একখানা জিজ বা তালিকা প্রণয়ন করেন। তার এ জিজের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঔপপত্তিক উপক্রমণিকা সংযোগ করেন। এ বিষয়ে এ উপক্রমণিকাই তার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর। এ সম্পর্কিত তার দুইখানা গ্রন্থ রয়েছে। প্রথম গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রপাতির নির্মাণ কৌশল আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কীরূপে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ নিতে হয়, তা সম্পর্কে আলোচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলো অনুবাদ করা হয় ইউরোপীয় ভাষায়। পরবর্তীতে এগুলো চীনা ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়।
৬. ভূগোল শাস্ত্র : তিনি টলেমি সুচিত অনেক ভৌগলিক ধারণার সংশোধন করেন। ইউরোপীয়রা এতে বিস্মিত হয়। টলেমির মানচিত্র পর্যন্ত তিনি সংশোধন করেন এবং তাতে একটি মানচিত্র সংযুক্ত করেন। তিনি টলেমির দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখা গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে তাতে মুসলিম দেশগুলোর বিবরণ পেশ করেন। তার উদ্যোগে পৃথিবীর একটি বাস্তবরূপ তৈরি করা হয়। যা পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কনে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি সর্বপ্রথম পৃথিবীকে সপ্ত ইকলিম বা মন্ডলে ভাগ করেন। এ সূত্র ধরে আবহাওয়ার পরিমন্ডল অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি মহাদেশে ভাগ করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর রচিত ভারতীয়দের একটি বই ‘সিদ্ধান্ত’ তিনি আরবিতে অনুবাদ করেন।
এক যুগের অধিক সময় বেঁচে ছিলেন : এ মহান খ্যাতিমান মুসলিম বৈজ্ঞানিক আনুমানিক ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পৃথিবীকে বিদায় দিয়ে পরকালে পাড়ি জমান। খলিফা মামুনুর রশিদের মৃত্যুর পরও তিনি এক যুগের অধিক সময় জীবিত ছিলেন। বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য আল খাওয়ারিজমি যুগ-যুগান্তর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। আজও তিনি আপন কীর্তিতে সমুজ্জ্বল। আধুনিক বিজ্ঞান মুসলমানদের কাছে কতখানি যে ঋণী এবং মুসলমানরা বিজ্ঞানচর্চায় যে কতখানি অগ্রসর ছিলেন, এ ঘটনা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অঙ্কশাস্ত্র উন্নয়নে মুসলমানরা যে অবদান রেখেছেন, তা কখনও ম্লান হওয়ার নয়। আ্যলজেবরা, জিরো, সাইফুর ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি আরবি ভাষা থেকেই। আর মুসলমান অঙ্কবিশারদরা এগুলোর আবিষ্কারক। মুসলমান অঙ্কবিশারদদের মধ্যে খাওয়ারিজমি, ওমর খৈয়াম, আল-বেরুনি খুবই খ্যাতিমান। এদের তুলনা চলে ইউক্লিডের সঙ্গে। সাধারণভাবে অঙ্কচর্চায় গ্রিকদের ব্যাপক খ্যাতি থাকলেও বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি ছিল তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা। এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুসলমানরাই ছিলেন অঙ্কশাস্ত্রের এ শাখার উদ্ভাবক।
লেখক : অনুবাদক ও গবেষক