ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশে দেশে কোরবানি ঈদ

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব। এ দিন পশু কোরবানির মাধ্যমে আত্মত্যাগ করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। অন্য সবকিছুর মতো স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে কোরবানিতেও বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর রয়েছে বিভিন্ন নাম। একেক দেশে একেক পশুর প্রাধান্য। পশু সংগ্রহের পদ্ধতিতেও রয়েছে ভিন্নতা। বৈচিত্র্যময় এমন কয়েকটি মুসলিম দেশের ঈদুল আজহা উদযাপন নিয়ে লিখেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দেশে দেশে কোরবানি ঈদ

বাংলাদেশ

ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদুল আজহা বাংলাদেশে পালিত হয়ে থাকে। এ দিন মুসলমানরা নতুন পোশাক পরে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যান। কুশল বিনিময় করেন। প্রত্যেক বাড়িতেই উন্নতমানের খাবার তৈরি হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কোথাও কোথাও নিমন্ত্রিত হয়ে এ উৎসবে যোগদান করেন। এ উপলক্ষে কয়েক দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রবাসীদের অধিকাংশই নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈদ উদযাপন করেন। বিভিন্ন মসজিদণ্ডময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পত্রপত্রিকাগুলোয় ঈদুল আজহার তাৎপর্য তুলে ধরে মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ বা বকরা ঈদ নামে পরিচিত। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় দু’ভাবেই পালন করা হয় এটি। প্রায় এক মাস আগে থেকে সাড়া পড়ে যায়। দোকান কিংবা সুপার মার্কেটগুলো জমজমাট থাকে ক্রেতার ভিড়ে। কোরবানির পশু ক্রয়ের জন্যও চলে প্রায় ১৫ দিন আগ থেকে তোড়জোড়। কেউ কেউ বাইরে থেকে উট আনলেও গরু, ছাগল এবং মহিষই এখানে বেশি মাত্রায় কোরবানি দেয়া হয়।

ভারত

ভারতীয় মুসলমানরা সাধারণত ঈদুল আজহার জন্য ছাগল বা ভেড়া কোরবানি করে থাকেন। ঈদের নামাজের জন্য সেখানে নির্ধারিত এলাকা আছে। যেহেতু ওই দেশে গরুকে পবিত্র বলে মনে করা হয়, তাই ভারতীয় মুসলমানরা সাধারণত তাদের বাড়িতে বা স্থানীয় ইসলামিক কেন্দ্রে একটি ছাগল বা ভেড়া কোরবানি দেন। মাংস প্রস্তুত হওয়ার পরে বাড়িতে এনে রান্নার কাজে লেগে পড়েন সবাই। সাধারণ জনগণের অসুবিধা এড়াতে সেখানকার কর্তৃপক্ষ রাস্তায় পশু কোরবানি করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভারতে একদিনের সরকারি ছুটি পালিত হয়। দেশটির মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে খুব সাধারণভাবেই ঈদুল আজহা পালিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ঈদুল আজহা বকরা ঈদ নামে পরিচিত। নামটি মূলত বকরি কোরবানির ধারণা থেকেই গৃহীত। বৃষ্টি না হলে এ দিনের ঈদের নামাজ ঈদগাহেই পড়া হয়। সেখান থেকে ফিরে পশু কোরবানি। যারা কোরবানি করেন, তারা দরিদ্র এবং আত্মীয়দের দাওয়াত করেন। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা-দর্শনের উদ্দেশ্যে অনেকেই বেরিয়ে পড়েন। যেহেতু ভারতের মাটি সুদীর্ঘকাল ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল, তাই তা থেকে নিজেদের পূর্বপুরুষের চিহ্নে খুঁজে পান নতুন প্রেরণা।

পাকিস্তান

পাকিস্তানে ঈদুল আজহা চার দিনব্যাপী উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বেশিরভাগ স্থানীয় দোকান এবং শপিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। নামাজের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। সামর্থ্যবান প্রতিটি পরিবার তাদের সাধ্যমতো পশু কোরবানি করেন। যারা কোরবানি করতে পারেননি কিংবা যারা অক্ষম, তাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। উট ও দুম্বা এ দেশে কোরবানির জন্য প্রাধান্য পায়। সকালে ঈদগাহে ঈদের নামাজ ও খুতবার পর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানির পর গোশত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করা হয়। ঈদের দিন সকালে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নামাজের জন্য রওনা দেন। তারপরে বাড়ি ফিরে গরু, ছাগল, ভেড়া বা উট কোরবানি করেন। পাকিস্তানে সবাই পালিত পশুই কোরবানি দেয়ার চেষ্টা করেন। এ জন্য অনেক আগ থেকে পশু কেনাবেচা শুরু হয়। অন্তত এক মাস আগে তারা পশু কিনে নিজেরা যত্ন করেন। সরকারি ছুটি থাকায় যে যার মতো করে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করে নেন।

সৌদি আরব

একদিকে পবিত্র হজ এবং অন্যদিকে কোরবানি- এ দুটো মিলে সৌদিতে ঈদুল আজহার উৎসব বেশ সুন্দর রূপ লাভ করে। এ দিন দেশটিতে থাকে সরকারি ছুটি। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী সৌদির জনগণ এবং বহিরাগত হাজিরা ঈদুল আজহা পালন করেন। ঈদের নামাজের পর খুব সকালে পরিবারের সবাই মিলে পশু কোরবানি করে থাকেন। তারপর সেখান থেকে কিছু গোশত এনে বাসায় রান্নাবান্না করেন। নাশতা শেষে সবাই আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যান। নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করে থাকেন। কোরবানির পশুর গোশতকে তারা খাবারের বরকত হিসেবে বিবেচনা করেন। যেহেতু হজের শেষ দিনে কোরবানি করা হয়, তাই সৌদি আরবের এ ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। দেশটির জনগণ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজের উদ্দেশ্যে আসা মুসল্লিরা একসঙ্গে এখানে পশু কোরবানি করেন। এখানে কোরবানির জন্য উটই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া দুম্বাও কোরবানি করা হয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

আরব আমিরাতে কোরবানির পশু কেনার আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে ঘরে বসে ভিডিওকলের মাধ্যমে পশু ক্রয় করে থাকেন। ঈদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে খুব ঘটা করে এখানে কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির জন্য প্রায় প্রতিটি পরিবার একাধিক পশু কেনেন। ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়ে সবাই নিজ নিজ পশু কোরবানির মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করেন। ধনীরা দান করার জন্য এ দিন খোলা মনে বের হন। ঈদুল আজহায় ১০ দিন আগে চাঁদ দেখে দিন নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ উৎসবের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়ার সময় পান সবাই। এ জন্য ঈদের দিনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত সুপার মার্কেটগুলোতে ভিড় লেগে থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কমপক্ষে তিন দিন সরকারি বন্ধ দেয়া হয়। সব থেকে গুরুত্ব দেয়া হয় ঠিক আগের দিন অর্থাৎ আরাফাতের দিনকে। হজ না করলেও মুসলমানরা এ দিন ইবাদতে অংশগ্রহণ করেন। ঈদের দিন সবাই মিলিত হন ঈদগাহে। নামাজের পরে পরস্পর কোলাকুলি ও ঈদ মোবারক জানিয়ে পরস্পরকে অভিবাদন জানান। এর মধ্যদিয়ে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী উৎসব। বিনিময় ঘটে উপহারের। শিশুরা দিনটাতে নতুন কাপড় পরে প্রতিবেশীদের ঈদ বিস্কুট বিলি করে। বাড়িকে সাজানো হয় ঈদের ব্যানারে। দুধ খুরমো এবং শির খুরমো নামে সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। আগের রাতে মেহেদি পরার সংস্কৃতি আরব আমিরাতে বেশ ভালোভাবে আছে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্যে বিশেষ ছাড় ও অফার দেয়া হয়। এ জন্য অনেকে সুযোগটাকে হাতছাড়া হতে দেয় না। পরিবার নিয়ে বিভিন্ন রিসোর্টে ভ্রমণ কিংবা রেস্টুরেন্টে খাবার-দাবারের দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক। পশু কোরবানির আগে সকালে ঈদের নামাজ আদায় করা হয় সেখানে। যদিও সেখানকার মানুষ নিজের বাড়িতে পশু জবাই করতে পারেন, তবে যথাযথভাবে কোরবানি ও এর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের লক্ষ্যে কসাইখানার স্থান নির্ধারণ করা থাকে। এ কারণে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কারের বিষয়ে আর ভাবতে হয় না তাদের।

মিশর

দেশটিতে ঈদুল আজহা মূলত সকালে মসজিদগুলোতে একত্রে নামাজ পড়া ও খুতবা শোনা এবং তারপর পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এটাই ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতা। ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতার পরই সবাই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন। একসঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন। এ দিনে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা দরিদ্রদের মাঝে গরুর গোশত এবং অন্যান্য খাদ্য বিতরণ করে। এ দিন সারা দেশে সরকারি ছুটি থাকে। মিশরের মুসলিম জনগোষ্ঠী ৯০ শতাংশ। মিশরীয়রা একে অপরকে অভিনন্দন জানায় পবিত্র ঈদুল আজহায়। ঈদকে ঘিরে আয়োজন করা হয় হরেক কিসিমের খাবারের। শহরব্যাপী অভাবীরা দিনটার জন্য অপেক্ষায় থাকে, ধনী কিংবা মুসলিম সংস্থাগুলো থেকে যেন পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা পায়। মিশরে ঈদুল আজহার উৎসব শুরু হয় জিলকদের শেষের দিনগুলো থেকে। ঘরবাড়ি সাজানো হয়, গ্রাম ও মরু অঞ্চল থেকে কোরবানির জন্য পশু শহরে নিয়ে আসা হয়। ঈদের নামাজের পর নারীরা একটি ঘরে সবাই একত্রিত হন। সেখানে সবাই মিলে বাচ্চাদের উপহার, সেলামি ও বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দিয়ে থাকেন। মাগরিবের নামাজের পর আবার সবাই সমবেত হন। দস্তরখানা বিছিয়ে রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করেন।

মরক্কো

ঈদুল আজহা মরক্কোতে ঈদুল কাবির নামে স্বীকৃত। সাধারণত অন্যান্য দেশের মতো দিনটা শুরু হলেও স্থানীয় সংস্কৃতির আমেজ দেখা যায়। ঈদের নামাজের পর পশু কোরবানিকে গণ্য করা হয় আল্লাহর উদ্দেশ্যে ত্যাগ। পশু গরু, ছাগল কিংবা ভেড়া থাকে। মরক্কো একসময় মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্যতম বিচরণভূমি থাকায় ইসলামি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। ঈদের দিন তারা স্থানীয় মসজিদ ও স্থাপত্য পর্যবেক্ষণে সময় দিতে পছন্দ করে। তা ছাড়া কোরবানির পশু এবং তাজিনের মতো স্থানীয় খাবার আত্মীয় ও দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকে।

ইরান

ঈদুল আজহার দিনে খুব ভোরে উঠে নতুন পোশাক পরিধান করে প্রস্তুত হয় ইরানের মানুষ। স্থানীয় মসজিদ কিংবা মাঠে হাজির হয়ে আদায় করে ঈদের নামাজ। ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং আলোচনা চলে দেশব্যাপী। ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনাকে স্মরণ করে কোরবানি করা হয় বিভিন্ন ধরনের পশু। গরিব, পরিবার, বন্ধু এবং আত্মীয়দের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয় খাবার। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে সুষম বিলি-বণ্টন করা হয়। এ বিলি বা দান মূলত কোরবানির শিক্ষা। শিশু আর আত্মীয়রা পায় উপহার। যাদের কোরবানি দিতে দেখা যায়, আহ্বান করা হয় গরিব ও অভাবীদের জন্য এগিয়ে আসতে। খাদ্যদ্রব্যের জন্য ইরানে ঈদুল আজহা নোনতা ঈদ বলেও অভিহিত হয়। কোরবানির পশুর গোশত দিয়ে নানান কিসিমের মুখরোচক খাদ্য প্রস্তুত করা হয়। বিশেষভাবে, বিভিন্ন ধরনের কাবাব এবং হালিম। বাঘালির মতো স্থানীয় খাবারেরও প্রাচুর্য থাকে এ সময়।

তুরস্ক

মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু তুরস্ক। ঈদ সেখানে সবচেয়ে পুরোনো উৎসবের মধ্যে একটি। আনাতোলিয়ার তুর্কি বেলিক এবং পরবর্তীদের অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থানে তুরস্কে ঈদকে অন্যরকম মর্যাদায় উন্নীত করেছে সবার মধ্যে। পুরোনো বিশ্বাসমতে, এ দু’দিনের মধ্যে বিয়ে কিংবা নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করা ঠিক নয়। প্রত্যেক বাড়ি থেকে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়া হয়। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঈদের বিশেষ নামাজের পর শুরু হয় কোরবানি। কোনো কোনো অঞ্চলে পশুকে মেহেদি এবং কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। অন্যান্য অঞ্চলের মতোই কোরবানির গোশত বণ্টন করে আত্মীয় ও অভাবীদের মধ্যে বিলি করা হয়। পশু হিসেবে থাকে সাধারণত মেষ। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে কেউ কেউ পশু কোরবানি না করে সমপরিমাণ অর্থ দরিদ্র তহবিল কিংবা মুসলিম উন্নয়ন সংস্থায় দান করে। কেউ দরিদ্রদের বিশেষ দেখাশোনার ভারও গ্রহণ করে। ছুটির প্রথম দিনটা থাকে মূলত প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য। বয়স্কদের হাতে চুমু দেয়া সম্মান জানানোর নামান্তর। বন্ধ থাকে মোটামুটি চার দিন। ঈদুল আজহাকে তুর্কি ভাষায় কোরবান বায়রামি বলা হয়। তুরস্কেও অনুমোদিত কসাইখানা ছাড়া অন্য কোথাও পশু কোরবানি করা বেআইনি। এগুলোর বেশিরভাগ বড় শহরের উপকণ্ঠে নির্মিত।

তাজিকিস্তান

তাজিকিস্তানের মানুষ ঈদের নামাজের মধ্যদিয়ে শুরু করেন ঈদুল আজহা। তারপর শিশুরা প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখান থেকে তারা পুরস্কার ও মিষ্টি পেয়ে খুশি হয়। এর পর পুরুষরা পশু কোরবানির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাজিকিস্তানেও অনুমোদিত স্থান ছাড়া কোরবানি দেয়ার নিয়ম নেই। মাংস নিয়ে বাড়িতে আসতেই তা রান্না শুরু করেন নারীরা। তাজিকিস্তানে বাড়ির শিশুরাই ঈদের দিন খাবার পরিবেশন করে। অতিথিকে প্রথমে ফল, পেস্ট্রি ও বিস্কুট নাশতায় দেয়া হয়। তারপরে মাংসের বাহারি পদ দিয়ে খাবার সম্পন্ন করার পর কেক ও মিষ্টি মুখ করে সবাই। তাজিকিস্তানে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ দেশের প্রতিবেশীরা অবাধে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে পারে। কারণ, তাদের সবার ঘরের দরজা প্রতিবেশীদের জন্য সব সময় খোলা থাকে।

ফিনল্যান্ড

ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ফিনল্যান্ডজুড়ে মুসলমানরা উদযাপন করেন বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। নতুন পোশাক পরে ফিনল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সমবেত হন ঈদের জামাতে। রাজধানী হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের জামাত। সালাতুল ঈদ শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় করা হয় দীর্ঘ মোনাজাত। বরাবরের মতো এবারও বাঙালিদের ঈদ উৎসবে সেখানে দেশি-বিদেশি রকমারি খাবার, বাংলাদেশিদের ন্যায় একে অপরের বাড়িতে নেমন্ত্রণ খাওয়া, মাতৃভূমি বাংলাদেশে টেলিফোন করে পরিবারের ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও খোঁজখবর নেয়াসহ নানা আয়োজনে মশগুল থাকছেন তারা।

নিউইয়র্ক

বর্তমানে নিউইয়র্কে প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন; যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকেন তারা। সবচেয়ে বৃহত্তম ঈদজামাত অনুষ্ঠিত হয় সেখানের অন্যতম বাংলাদেশি প্রধান এলাকা জ্যামাইকায়। শহরের ম্যানহাটান, জ্যাকসন হাইটস, উডসাইড ও ব্রুকলিন এলাকায় বাংলাদেশিদের পরিচালিত জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ জামাতটি। প্রতিবছরই এতে প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন। ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় জেএমসিতে তিনটি জামাতের ব্যবস্থা করার পরও বহু মুসল্লি জামাতে অংশ নিতে না পারায় জেএমসি দু’বছর ধরে দশটি খোলা মাঠে নামাজের ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের মুসলিম নর-নারী এসব খোলা মাঠসহ নগরীর শতাধিক মসজিদে ঈদুল আজহার জামাতে শরিক হন। এ ছাড়া মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড়ে কোনো কোনো মসজিদে পাঁচটি ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দেশ, বিশেষত পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা যেসব মসজিদ পরিচালনা করেন, সেসব মসজিদেও একাধিক ঈদজামাত অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের মতো পশু কেনাবেচার খোলা হাট নেই। নির্ধারিত স্লটার হাউস বা কসাইখানা ছাড়া পশু জবাইয়ের অনুমতিও নেই। তাই কোরবানি দিতে আগ্রহীদের বেশিরভাগ লোক বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি মালিকানাধীন কোরবানির অর্ডার গ্রহণকারী গ্রোসারিগুলোতে ঈদুল আজহার অন্তত দেড় মাস আগ থেকে তাদের সামর্থ্যানুযায়ী অর্থ জমা দেন। এর পর বিকেলে তারা প্রত্যেকের জন্য কোরবানির মাংস গ্রোসারিতে এনে রাখেন বা কোরবানিদাতার কাছে পৌঁছে দেন। এ ছাড়া অনেকে নগরীর অদূরে অবস্থিত ফার্মে গিয়ে গরু, ছাগল, ভেড়াসহ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পশু কিনে ফার্মের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কোরবানি দিয়ে থাকেন। তবে গ্রোসারির মাধ্যমেই কোরবানি দেয়াকে অধিকাংশ বাঙালি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

ইন্দোনেশিয়া

আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানি আদায় করা হয় সামাজিকভাবে। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা হাট থেকে কোরবানির পশু কিনে মসজিদে দিয়ে আসেন। ৮-১০টি পশু এসে যায় কোনো কোনো মসজিদে। মসজিদ এলাকায় কতগুলো পরিবার আছে, তার হিসাব ইমামের কাছে থাকে। সবাই মিলে কোরবানির পর যতগুলো ঘর আছে, গোশত তত ভাগে ভাগ করে ছোট প্যাকেটে সবার ঘরে দিয়ে আসেন। তবে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা তা না নিয়ে গরিবদের দিয়ে দেন। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটি থাকে। এ দিনে ইন্দোনেশীয় মুসলমানরা সকালে নামাজ ও খুতবার মধ্য দিয়ে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। তারপর গবাদি পশু (যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি) কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহার মূল আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। তারা কোরবানির মাংস আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করেন।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় মোট জনগণের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম। তাই ঈদুল আজহায় মালয়েশিয়ায় দেখা যায় উৎসবের আমেজ। সকালে ঈদজামাত ও পশু কোরবানির পর নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে ঈদ পালন করতে দেখা যায় তাদের। পশু কোরবানির পর এ দিন রাস্তাঘাটে মশাল জ্বালানো কিংবা আতশবাজি পোড়ানো হয়। এ দিনে মালয়েশিয়ার মুসলিম পরিবারগুলোর দরজা সবার জন্য সব সময় খোলা থাকে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে এভাবে ভাগ করে নেন ঈদ-আনন্দ। মালয়েশিয়ায়ও সমাজবদ্ধভাবে কোরবানি করা পছন্দ। স্থানীয় মসজিদে কোরবানি করে গোশতও এক সঙ্গেই বণ্টন করা হয়। ইদানীং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ‘বিলাসী’ কোরবানির হাট গড়ে উঠেছে। ল্যাপটপ ও ট্যাব হাতে সেলসম্যানের উপস্থিতিতে হাটগুলোতে দেখা যায় ভিন্নমাত্রা। এগুলো হাট না বলে কোরবানির পশুর শোরুম বলা যায়। দামি দামি গাড়িতে করে ধনী ক্রেতারা ওইসব শো-রুমে ভিড় জমান। চড়া দামে কেনেন পশু।

রাশিয়া

রুশ ভাষায় ঈদুল আজহাকে বলা হয় ‘কোরবান বাইরাম’। আয়তনে পৃথিবীর বৃহত্তম এ দেশের মোট জনসংখ্যা কমলেও ব্যাপকভাবে বাড়ছে মুসলমানের সংখ্যা। মোট দুই কোটি মুসলমানের ২০ লাখই বাস করেন মস্কোতে। রাজধানী মস্কোতে ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে পালিত হয় ঈদুল আজহা। বিগত বছরে নগর কর্তৃপক্ষ দুটি পার্কে ঈদের জামাত আয়োজন করায় খোলা ময়দানে জামাতের আমেজ এসেছে মস্কোতেও। মস্কোর ৩৯টি মসজিদে ব্যবস্থা করা হয় ঈদ-জামাতের। তা ছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত তিনটি প্রদেশে ঈদ উপলক্ষে একদিনের সরকারি ছুটি থাকে। কয়েক লাখ মুসলমান সেখানে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভি ‘চ্যানেল রাশিয়া’ এর সরাসরি সম্প্রচার করে। কোরবানির জন্য অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। ঈদের জামাতের পর রাশিয়ার মুসলমানরা কোরবানির জন্য নগরের বাইরের নির্দিষ্ট স্থান অথবা খামারে গিয়ে কোরবানি করেন।

চীন

চীনের মুসলমানদের কাছে ঈদুল আজহা ‘ঈদ আল গোরবান’ বা ‘ঈদ আল কোরবান’ নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। মসজিদগুলো পূর্ণ হয়ে এর সংলগ্ন মাঠ বা খোলা জায়গাগুলোও লোকারণ্য হয়ে যায়। ঈদের জামাত শেষে বাড়িতে বাড়িতে ভেড়া, উট বা গরু কোরবানি করেন চীনা মুসলমানরা। চীনারা সাধারণত কোরবানির গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করে এর এক ভাগ নিজেদের জন্য রেখে বাকি দুই ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। মসজিদকেন্দ্রিকও কোরবানি করা হয় কোথাও কোথাও।

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মুসলমান। প্রত্যেক এলাকায়ই কিছু কিছু মুসলমানের বাস রয়েছে। মুসলমানদের আলাদা এলাকাও রয়েছে। সেখানে কোরবানির প্রায় তিন মাস আগে কোরবানির পশুর জন্য নিকটতম কোনো মসজিদের মাধ্যমে দরখাস্ত করতে হয়। সরকার অস্ট্রেলিয়া থেকে পশু এনে সেই মসজিদে হস্তান্তর করে। কোরবানিদাতা মসজিদের কাছে কোরবানি করে এর গোশতের কিছু অংশ নিজের জন্য নিয়ে আসেন, আর বাকিটা অন্যান্য মুসলমানের জন্য মসজিদে রেখে আসেন। মসজিদ থেকেই কোরবানির গোশত গরিবসহ অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

জার্মানি

প্রায় ছয় লাখ আট হাজার মুসলিম নাগরিক রয়েছে জার্মানিতে। তাদের বেশিরভাগই বার্লিন, কোলন, ফ্রাংকফুর্ট, স্টুটগার্ট এলাকার বাসিন্দা। এ ছাড়া আরও কয়েক লাখ মুসলমানের বাস জার্মানিতে। জার্মানির দু’হাজার মসজিদে ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো বাড়িতে কোরবানির সুযোগ নেই। কোরবানির জন্য বিশেষ জায়গা রয়েছে। সেখানে আগ থেকেই অর্ডার নেয়া হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ঈদে ছুটি মেলে না। জার্মানিও সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এ দেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এ কারণেই জার্মান মুসলিমরা দুই ঈদের কোনো ঈদেই ছুটি পান না। জার্মানির অধিকাংশ মুসলমান বার্লিনে থাকেন। ওখানেই তারা ঈদের নামাজ আদায় করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত