ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যেসব কারণে মক্কায় হাজীরা মারা যান

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
যেসব কারণে মক্কায় হাজীরা মারা যান

প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান। হজের সফরে বিভিন্ন কারণে অনেকের মৃত্যু সংবাদ শোনা যায়। তবে চলতি হজের মৌসুমটি বাড়তি শোকাবহ হয়ে উঠেছে। এবারের হজযাত্রায় বিভিন্ন দেশের অন্তত ৯২২ জন হাজীর মৃত্যু হয়েছে। যার বেশির ভাগের পেছনে তীব্র গরমের দিকটি উল্লেখ করছে বার্তা সংস্থা এএফপি। ১৯ ও ২০ জুন সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে মৃত্যু এবং এ নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। যদিও এ বছর হজ মৌসুমে স্বাস্থ্য পরিকল্পনার সাফল্যের দিক তুলে ধরেছে সৌদি আরব। বড়সংখ্যক হজযাত্রী এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চ্যালেঞ্জ হলেও হজ মৌসুমে কোনো ধরনের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকিমুক্ত বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ আল জাল্লায়েল। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বছর প্রায় ১৮ লাখ ৩০ হাজারের মতো হাজী এ তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। যার মধ্যে ১৬ লাখই এসেছিলেন বিদেশ থেকে। এ বছরের হজে এত বেশি মৃত্যুর বেশ কয়েকটি কারণ দৃশ্যত ফুটে ওঠে।

চরম তাপে উত্তপ্ত পরিস্থিতি : এবার সৌদি আরবে তাপমাত্রা ছায়ার মধ্যেই ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ছিল। এ পরিস্থিতিকেই একটা বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চতাপ ও পানিশূন্যতা এড়াতে সতর্কতা জারি করলেও অনেক হাজী তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা এবং হিটস্ট্রোকের শিকার হয়েছেন। দুই ডজনের বেশি দেশ থেকে হজ পালনে আসা মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে মিশরীয়দের। একজন আরব কূটনীতিক জানিয়েছেন, মিশরের যে ৬৫৮ জন ব্যক্তির মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে, তার প্রায় সবই চরম তাপের কারণে হয়েছে। এ হাজীদের অনেকেরই যথাযথ হজ পারমিট ছিল না। যার ফলে তাদের ক্ষেত্রে হাজীদের জন্য নির্ধারিত সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ছিল। তারা যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেখানে অত্যধিক গরম ছিল। কাবার সব দরজা বন্ধ ছিল। অনেককে ছাদ ব্যবহার করতে হয়েছে। সেখানে প্রচণ্ড তাপে যেন তারা জ্বলছিল। অনেককে ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছে। ক্রমাগত জমজম পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে রাখতে হয়েছে। নাঈম নামে একজন হাজী হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। তার ছেলে জানান, ‘আমার বাবার সঙ্গে হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পেরেছি, তিনি হজের সময় মারা গেছেন।’

তাপের সঙ্গে অভ্যস্ত না থাকা : কঠিন ধরনের শারীরিক কাজকর্ম, বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা এবং হাজীদের অনেকে বয়স্ক বা অসুস্থ থাকায় হাজীদের জন্য ঝুঁকি থাকেই। হজের সময় গরমের কারণে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয় এবং ১৪০০ সাল থেকে মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে। গত বছরও গরমের কারণে কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হওয়ার ২০০০ ঘটনার তথ্য দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের কার্ল-ফ্রেডরিচ শ্লেউসনার রয়টার্স নিউজ এজেন্সিকে বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার গবেষণা অনুযায়ী শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ের তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বাড়লে হজের সময় হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচগুণ বেড়ে যেতে পারে। বর্তমান পূর্বাভাস অনুযায়ী পৃথিবীর উষ্ণতা ২০৩০-এর দশকের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে; যা ভবিষ্যতে হজযাত্রীদের আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।

অতিরিক্ত ভিড় ও পরিচ্ছন্নতাজনিত সমস্যা : বিভিন্ন মানুষের বয়ান থেকে যেমনটা জানা যাচ্ছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে চরম পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। যার ফলে হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত অনেক এলাকায় বিভিন্ন সংকট দেখা গেছে। অনেকে বলছেন, থাকার জায়গা বা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে ভালো ছিল না। ফলে তাঁবুগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় ও পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত সুবিধার ঘাটতি ছিল। ইসলামাবাদ থেকে আসা ৩৮ বছর বয়সি একজন হজযাত্রী জানান, ‘মক্কার তাপে আমাদের তাঁবুগুলোতে কোনো এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যে কুলারগুলো বসানো হয়েছিল, তাতে বেশিরভাগ সময় পানি ছিল না।’ কিছু হাজী অভিযোগ করেছেন, কিছু তাঁবুতে শীতলীকরণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না। এ তাঁবুগুলো এতটা শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে, আমরা ঘেমে ভিজে যাচ্ছিলাম। এটি একটি ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল। জাকার্তার একজন হাজী জানান, ‘তাঁবুগুলোতে ভিড় এবং অতিরিক্ত তাপের কারণে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আমরা রাত পর্যন্ত রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা করেছি। তাই তাঁবুর লোকেরা ক্ষুধার্ত ছিল।’

পরিবহন বিড়ম্বনা : প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই হাজীরা প্রায়ই দীর্ঘ পথ হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্য অনেকে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা আটকে দেওয়া এবং খারাপ পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন। এক পাকিস্তানি হাজী বলেন, ‘আমাদের ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; যেখানে কোনো পানি ও ছায়া ছিল না। পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়ে আমাদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে বাধ্য করেছে।’ তার মতে, সৌদি সরকারি যানবাহন পাওয়া গেলেও গরমের কারণে অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়া তীর্থযাত্রীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না। ক্যাম্পে মানুষকে মুরগি বা খামারের পশুর মতো রাখা হয়েছিল। দুই বিছানার মাঝে দিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না। কয়েকটি টয়লেট শত শত মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল না। যদিও একটি বেসরকারি দলের হজ সংগঠক মুহাম্মদ আচা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে একমত। তিনি জানান, এটি আমার ১৮তম হজ। আমার অভিজ্ঞতায়, সৌদি নিয়ন্ত্রকরা সাহায্যকারী নয়। তারা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু সাহায্য করে না।’ আচার মতে, গ্রীষ্মকালে একজন সাধারণ হাজীকে দিনে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হতে পারে। এতে তাদের হিটস্ট্রোক, ক্লান্তি এবং পানির সংকটে ভোগার ঝুঁকি রয়েছে। আগেকার বছরগুলোতে তাঁবুতে প্রবেশের জন্য ইউটার্নগুলো খোলা ছিল। কিন্তু এখন সেই সমস্ত রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে একজন সাধারণ হাজী এক নম্বর জোনের ‘এ’ ক্যাটাগরি তাঁবুতে থাকলেও তাকে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছাতেই গরমের মধ্যে অন্তত আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হয়। যদি এ রুটে কোনো জরুরি পরিস্থিতি ঘটে, তাহলে ৩০ মিনিটের মধ্যে কেউ পৌঁছাতে পারবে না। জীবন বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি পথে পানির পয়েন্টও নেই।

বিলম্বিত চিকিৎসা সহায়তা : অনেক হাজীই পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পাননি বলে জানা গেছে। অনেকে বলছেন, যারা তীব্র গরমে ক্লান্তি বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগেছেন, তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা প্রাথমিক চিকিৎসা সহজে পাওয়ার উপায় ছিল না। একজন সহযাত্রীর ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার বা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল। তখন তাদের মরিয়া অনুরোধ সত্ত্বেও অ্যাম্বুলেন্স আসতে ২৫ মিনিটেরও বেশি সময় লেগেছে। অবশেষে একটি অ্যাম্বুলেন্স এলো এবং ডাক্তার তাকে দুই সেকেন্ডও দেখেননি। তার কিছু হয়নি বলে চলে গেলেন। অবশ্য হজযাত্রীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বরাদ্দকৃত সম্পদের কথা তুলে ধরেছেন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা ৬৫০০ শয্যার সক্ষমতাসম্পন্ন ১৮৯টি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মোবাইল ক্লিনিক চিকিৎসা সেবায় যুক্ত করেছে। ৪০ হাজারের বেশি চিকিৎসা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক বিষয়ক কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, সেখানে ৩৭০টির বেশি অ্যাম্বুলেন্স, ৭টি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, শক্তিশালী লজিস্টিক নেটওয়ার্কসম্পন্ন ১২টি ল্যাবরেটরি, ৬০টি সরবরাহ ট্রাক এবং তিনটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সামগ্রী সংবলিত গুদাম স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে।

নথিবিহীন হজযাত্রা : হজ করতে একজন হাজীকে একটি বিশেষ হজ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। কিন্তু কিছু ব্যক্তি সঠিক কাগজপত্র ছাড়াই হজে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ অনুমোদনহীন হজ সমস্যা অতিরিক্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। যারা সঠিক কাগজপত্র ছাড়া হজ করেন, তারা কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলেন। এমনকি প্রায়ই সাহায্যের প্রয়োজন হলেও কিছু তাঁবুতে ভিড়ের জন্য কর্তৃপক্ষ তাদের দায়ী করেছেন। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় হজ ও উমরা কমিশনের চেয়ারম্যান মুস্তোলিহ সিরাজ জানান, ‘আমাদের সন্দেহ, যাদের হজের ভিসা নেই, তারা হজ এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে।’ একজন আরব কূটনীতিকের বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, এ মৌসুমে অন্তত ৬৫৮ জন মিশরীয় মারা গেছেন। যার মধ্যে ৬৩০ জনের হজ পারমিট ছিল না। জাতীয় হজ ও উমরা কমিটির উপদেষ্টা সাদ আল কুরাইশি জানান, ‘যাদের কাছে হজের ভিসা নেই, তাদের বরদাশত করা হবে না। তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে।’ বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, নুসুক কার্ডের মাধ্যমে অনিয়মিত হাজীদের চিহ্নিত করা হয়; যা সরকারি হাজীদের দেওয়া হয় এবং তাতে মক্কায় প্রবেশের জন্য একটি বারকোড থাকে।

বয়োজ্যেষ্ঠ, রুগ্ন বা অসুস্থ তীর্থযাত্রী : অনেক হাজী জীবনের শেষের দিকে হজে যান। অনেকে আবার নানা অসুস্থতা ও রোগ নিয়ে হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় পাড়ি জমান। অনেকে আশা করেন, মৃত্যু হলে যেন সেখানেই হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মুসলমানরা হজ পালনের সময় মারা যাওয়া সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করেন। মনে করা হয়, এটি একটি বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে। হজে প্রতি বছর মৃত্যুর এটি একটি কারণ।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত