বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকদের অভিবাসনের হার কমে গেছে বলে সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে নারী কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কিছুটা কমলেও ২০২২ সালেও সেই সংখ্যা এক লাখের ওপরে ছিল। কিন্তু গত বছর তা কমে এক লাখের নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়েছেন ৭৬ হাজার ১০৮ জন নারী কর্মী। যদিও এ বছরের শুরুর চার মাসে নারীদের অভিবাসী হওয়ার হার আরো কমেছে। গত কয়েক বছরের তথ্যে দেখা গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছেন অসংখ্য নারী। এছাড়া সেখানে কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়াও আত্মহত্যা ও খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নারী। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার কারণে নারী কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা : বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে। যেসব দেশে নারী কর্মীরা যায়, এগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ওমান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, সাইপ্রাস, মৌরিতাস, হংকং, ইতালি, জাপান ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী নারীদের বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যায়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ ৬২ হাজার ৭৯১ জন নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে যান। সরকারি এ সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিদেশে নারী কর্মী যাওয়ার পর থেকে ২০১৭ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী বিদেশে যান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বছরে এক লাখের বেশি নারীকর্মী পাঠানোর ধারা অব্যাহত ছিল।
নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা : করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরে এ সংখ্যা কমলেও ২০২২ সালে আবার লাখের ঘর পেরোয় নারীকর্মী বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা। গত বছর আবার কমে লাখের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ গতবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক প্রবাসী হয়েছে। এ সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি; কিন্তু নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে হয়েছে ৭৬ হাজার ১০৮ জন। এ বছরের প্রথম চার মাসে ২১ হাজার ৫৫৮ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। সরকারি বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সৌদি আরবেই সর্বোচ্চ বেশি নারীকর্মী যায়। এ হার ৬৩ শতাংশ। নির্যাতনের অভিযোগ ওঠায় ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব নারীদের অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই সুখকর হয় না বলে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে। কেন না, গৃহকর্মী হিসেবে যারা যায়, বেশিরভাগ সময়ই নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের অনেককে দেশে ফিরে আসতে হয়।
অকথ্য নির্যাতনের গল্পকথা : ২০১৮ সালে সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে মাত্র পাঁচ মাসেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন এমন একজন নারীর সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যমের। তিনি মানিকগঞ্জের একটি গ্রাম থেকে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী বলেন, এজেন্সি সৌদি যে মালিকের বাসায় দিছে, তারা খারাপ ছিল। কাজ করাত, খাবার চাইলে দিত না, কাপড়-চোপড় দিতো না। মালিক গায়ে হাত দিত। পাঁচ মাসে একদিনও এমন হয় নাই, তারা নির্যাতন করে নাই। পরে এমন অবস্থা দাঁড়ায়, টিকতে না পাইরা ওই বাসা থেকে পালাই। সৌদি পুলিশের কাছে সাহায্য চাই। পরে তারা অ্যাম্বাসির সঙ্গে কথা বলে কোম্পানির মাধ্যমে দেশে পাঠায়। মানিকগঞ্জেরই আরেকজন নারী সৌদি আরবে দেড় বছর থাকার পর ২০২২ সালে দেশে ফিরতে পেরেছেন। তিনি বলেন, যে সৌদি মালিকের বাসায় গেছি, সেখানে ঘরের কাজ করতে হইত। কিন্তু মালিক শারীরিক নির্যাতন করত। বাধা দিলে মেরে ফেলার কথা কইত। আবার বাসা থেকে পালাইতে যাতে না পারি, তালা দিয়া রাখত। চারবারের চেষ্টার পরে একদিন সুযোগ পাইয়া বের হয়ে যাই। পরে অ্যাম্বাসি দেশে পাঠাইছে।
ভিন্ন কাজে সাফল্যের মুখ দেখা : গৃহকর্মী হিসেবে গিয়ে যেমন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, আবার অন্য কাজে গেলে সফলভাবে দেশে ফেরার গল্পও রয়েছে নারীকর্মীদের। এদেরই একজন মনোয়ারা বেগম। মানিকগঞ্জের এ নারী জানান, ১৯৯৭ সালে সৌদি আরবে গিয়ে ১২ বছর রিয়াদের একটি হাসপাতালে সুইপারের কাজ করার পর তিনি দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ১২ বছর হাসপাতালে কাজ করছি। পরে দেশে ফেরত আসছি। এখান থেকে আবার লেবাবনে যাই এক বাসায় ঘরের কাজ করতে। সেখানকার মালিক খুবই ভালো ছিল। পরিবারের পুরুষরা বোনের মতো দেখত। চার বছর থাকার পর দেশে ফেরত আসছি।
বিভিন্ন পেশায় স্কিলড হওয়া প্রয়োজন : শারীরিক নির্যাতনের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে স্বীকার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তবে প্রশিক্ষিত হয়ে অন্য পেশায় নারীরা যাচ্ছে বলেও জানান তারা। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ আবদুল তারিক বলেন, বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগের কারণে নারীদের অভিজ্ঞতা ভালো না। তাই গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশ যাওয়া কমেছে। কারণ, এ পেশায় নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যায় না। এর প্রভাব পড়েছে পুরো সংখ্যায়। কিন্তু অন্য পেশায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা যাচ্ছে। আমরা চাই, নারীরা বিভিন্ন পেশায় স্কিলড হয়ে যাক। দেশের বিভিন্ন জেলায় ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। যদিও অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নারীকর্মী বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কমেছে, এ পরিসংখ্যানে এখনই পৌঁছানো যাবে না। কারণ, গত কয়েক বছরের নির্যাতনের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে সরকার কিছু বিষয়ে কঠোর হওয়ার ফলে এটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
নারী শ্রমিকদের মৃত্যুবিষয়ক পরিসংখ্যান : বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে এ গবেষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ পাঁচ বছরে ৭০৫ জন বাংলাদেশী নারী অভিবাসী কর্মীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের গড় বয়স ৩৭ বছর। ইউরোপ-আমেরিকার দেশে যেসব নারীর মৃত্যু হয়েছে, তাদের গড় বয়স ৪৬ বছর। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে যারা বিদেশ যাচ্ছেন, তাদের ১২ শতাংশ নারী। মারা যাচ্ছে নারী অভিবাসীদের তিন দশমিক ছয় শতাংশ। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়। সৌদি আরবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কারণ, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ নারীই সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যান। বিদেশ থেকে যেসব মৃতেদেহ আসে, তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মীদের। এসব মৃত্যুর ৩২ শতাংশই দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা ও খুন। বাকি ৬৮ শতাংশ নারী শ্রমিক মারা যাচ্ছেন হৃদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার ইত্যাদিতে। এগুলোকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে বিদেশে যারা মারা গেছেন, তাদের স্বজনরা বিশ্বাস করেন না যে, তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কারণ, মৃতদেহে কোনো না কোনো ধরনের ক্ষতচিহ্ন তারা দেখেন।
নির্যাতনের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ : রামরুর গবেষক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, গৃহকর্মী হিসেবে যেসব দেশে নারীরা যায়, সেখানে তাদের রেসপেক্ট করে না। ফলে তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অন্যায় নির্যাতন হয়। এ কারণে অনেকেই আর যেতে উৎসাহ বোধ করে না। একটা ভীতি কাজ করে। বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ‘সৌদি আরব ফেরত নারী গৃহকর্মীদের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ প্রতিবেদন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধু সৌদি আরব থেকেই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত এসেছে দুই হাজার ৩১৫ জন নারী। অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার নারীরা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগের সুযোগ পায় না অথবা করে না। ফলে এসব ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এর আগে ২০১৮ সালের তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নির্যাতনের শিকার নারীরা নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী থাকেন না। ফলে সৌদি সরকার বা বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু করার থাকে না। তবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রতিটি কেস সৌদি শ্রম দপ্তরে জানানো হয়। তিনি বলেন, কিন্তু ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারী তার নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করতে চান না। এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তারা দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। দীর্ঘসময় ধরে মামলা চলবে, সে আশঙ্কায় তারা আর সৌদিতে কালক্ষেপণ করতে চান না।
লেখক : কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী