র্যাডক্লিফ লাইনের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত বিশ্ব ডেস্ক
ভারত ভাগ হওয়ার পরপরই ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধ ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। যাতে বেশকিছু প্রাণহানি হয়। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের কার্গিলে আবার উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। যার পেছনে প্রধান কারণ সীমান্ত সমস্যা। সীমান্ত সমস্যার কারণে আজও কাশ্মীরে নিয়মিত রক্ত ঝরছে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যা গত ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সমাধান হয়। কিন্তু তার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এই ছিটমহলবাসীর জীবন ছিল অত্যন্ত মানবেতর। যার পেছনে একমাত্র দায়ী ছিল র্যাডক্লিফ ও তার দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতা। স্মর্তব্য, ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহেরুর ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নেহেরু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনিও চাননি ভারত বিভক্ত হোক। শুধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রবল ব্যক্তিত্ব ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সামনে ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের দাবিকে অখণ্ডনীয় বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। পাকিস্তানের দাবিকে যখন ধূলিসাৎ করা গেল না, তখন নেহেরু ও তার সাম্রাজ্যবাদী বন্ধু মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে বিকলাঙ্গ পাকিস্তান দেয়ার ব্যবস্থা করল। মুসলমানদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি উপেক্ষা ও ষড়যন্ত্র করে তাদের খর্বাকৃতির পাকিস্তান দেয়ার এসব গোপন পরামর্শের কথা পরবর্তীকালে ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক লাপিয়ের কৃত ‘Freedom at Midnight’ গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। দেশ বিভাগের সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছানুসারে ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে অথবা তাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখতে পারবে। এ সিদ্ধান্ত অনুসারেই মুসলমান অধ্যুষিত হায়দ্রাবাদের নিজাম মাউন্টব্যাটেনের কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, হায়দারাবাদ ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দেবে না, সে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। মাউন্টব্যাটেন উত্তরে নিজামকে জানান, তিনি তার পত্র যথাযথভাবে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং তিনি খুব শিগগিরই তার উত্তর আশা করছেন। পরবর্তীতে মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করেছেন, তিনি নিজামের পত্রটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রেরণই করেননি। মাউন্টব্যাটেনের এ স্বীকৃতির সঙ্গেই যোগ রয়েছে হায়দ্রাবাদকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের গভীর ষড়যন্ত্রের কথা। ভারত বিভাগের পরেও কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করেছিল। এ ছিল তার মুসলমানদের সঙ্গে বেঈমানির পুরস্কার। মাউন্টব্যাটেনকে কংগ্রেস কর্তৃক গভর্নর জেনারেল নিয়োগের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, দেশীয় রাজ্যগুলোকে চতুরতার সঙ্গে ভারতভুক্ত করা। দেশীয় রাজ্য হিসেবে কাশ্মীর ও হায়দ্রাবাদের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক এবং নেহেরুর দৃষ্টি বেশি করে পড়েছিল এ দুটি রাজ্যের ওপর। দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে হায়দ্রাবাদ নিজেকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। সেখানে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি স্বাধীন সরকারের জন্য যা যা প্রয়োজন, তাও চালু করা হয়। কিন্তু অখণ্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা নেহেরু এটা মেনে নিতে পারেননি যে, ভারতের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে পাকিস্তানের মতো আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তাই তিনি একে সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে রাতারাতি দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগ্রাসনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮। এ দিনটি নির্ধারণ করার পেছনে একটি কারণ ছিল, এর মাত্র দুদিন আগে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেছিলেন; সমগ্র পাকিস্তান তখন শোকে মুহ্যমান। ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল, এ সময় হায়দ্রাবাদে অভিযান চালালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাঁধা সৃষ্টি হবে না। কার্যত তা-ই হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে হায়দ্রাবাদের সেনাবাহিনী টিকে থাকতে পারেনি। মাত্র পাঁচদিনের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ৭০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে কাশ্মীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও রাজা ছিলেন হিন্দু। রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে। হরি সিং-এর সহায়তায় ভারত সেনা প্রেরণ করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও পাশতুন মিলিশিয়া বাহিনীর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এ যুদ্ধ চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলে ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে ভারত গণভোট দেবে না, এ আশঙ্কায় পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তার পরের বছর কারাকোরাম হাইওয়ে নির্মাণকালে পাকিস্তান এই কারাকোরাম ট্র্যাক চায়নার (৫ হাজার বর্গকিলোমিটার) হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তান এবং আমেরিকার সম্পর্ক যত তিক্ত হতে থাকে, কারাকোরাম ট্র্যাককে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ভূ-কৌশলগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ততই গাঢ় হয়। সেই থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ ভারত, পাকিস্তান ও চীন- এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ভারত বরাবরই পাকিস্তান ও চীন নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে। পাকিস্তানও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে। অন্যদিকে চীন ভারত নিয়ন্ত্রিত পুরো লাদাখ অঞ্চলটি নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে। কিন্তু কাশ্মীরের সঙ্গে হায়দ্রাবাদের পার্থক্য হচ্ছে, কাশ্মীরের জনগণ আজ পর্যন্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আজাদি আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে, আর হায়দ্রাবাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অত্যাচার আর নির্যাতনের স্টিম রোলারের তলায় স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন হায়দ্রাবাদের নাম পৃথিবী মনে রাখেনি। হায়দ্রাবাদ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, তার ছিল স্বাধীন প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা- এসব আজ বিস্মৃত প্রায়, ইতিহাসের গর্ভে আশ্রয় পেয়েছে।