ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখ জয়ের গল্প

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখ জয়ের গল্প

দীর্ঘ সংঘাত, অসংখ্য মানুষের রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে ককেশাসের জ্বলন্ত কড়াই হিসেবে পরিচিত নাগার্নো-কারাবাখ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হলো তথা আজারবাইজানের হাতে ফিরে এলো। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ নাগার্নো-কারাবখকে ‘বেহেশত’ আখ্যায়িত করেছেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ আজারবাইজান তার ভাষায় একটি ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরু করার একদিন পর জাতিগত আর্মেনিয়ান কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্ন নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। আজারবাইজানের ঝটিকা অভিযানে মাত্র ২৩ ঘণ্টায় কপোকাত হয় আর্মেনিয়া সমর্থিত সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের বলে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সেটির এতদিন নিয়ন্ত্রণ ছিল দখলদার আর্মেনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী নৃ-গোষ্ঠীর হাতে।

আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখ পুনরুদ্ধারের পর সেখানে বসবাসকারী ১ লাখ ২০ হাজার জাতিগত আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যেতে শুরু করে। আজারবাইজান কর্তৃক জাতিগত আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে নাগার্নো-কারাবাখে বসবাসের আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার লোক আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যেতে থাকে। এরই মধ্যে নাগার্নো-কারাবাখ জাতিগত আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা শূন্য হয়েছে বলে দাবি করেছে বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম। আর্মেনিয়ার দখলে যাওয়ার আগে নাগার্নো-কারাবাখ ও আশপাশের দখলীয় এলাকায় প্রায় আট লাখ আজেরি মুসলমান বসবাস করত। আর্মেনিয়ার জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের মুখে তারা আজারবাইজানে চলে যেতে বাধ্য হয়। এখন তারা আবার তাদের বসতভিটায় ফিরে আসার সুযোগ পেল।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার বিরোধের মূল কেন্দ্রবিন্দু ‘নাগার্নো-কারাবাখ’ পার্বত্য অঞ্চলটি আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং আর্মেনিয়ার সঙ্গে অঞ্চলটির কোনো সরাসরি সীমান্ত সংযোগ নেই। ১৯২১ সালে রুশ বলশেভিকরা নাগর্নো-কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯২৩ সালে অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে অঞ্চলটি আর্মেনিয়ার সমর্থনে আজারবাইজানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু আজারবাইজান নিজস্ব ভূমি হারাতে রাজি ছিল না। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৮৮-৯৪ সালের ৬ বছরের যুদ্ধে আজারবাইজানিরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। ওই সময় ৩০ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়। এ যুদ্ধে আর্মেনিয়া রাশিয়ার সহযোগিতা পেয়েছিল। যুদ্ধে ৪ হাজার ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নাগার্নো-কারাবাখ ছাড়াও আশপাশে অবস্থিত আজারবাইজানের ৫টি জেলা ও কাজাখ অঞ্চলের দুটি ছিটমহল দখল করে নিয়েছিল আর্মেনীয়রা।

আর্মেনিয়ান বাহিনী নাগার্নো-কারাবাখ থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার আজেরি মুসলিমকে তাড়িয়ে দেয়। মসজিদ, মাদ্রাসাসহ মুসলমানদের অসংখ্য স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে আজারবাইজানে থাকা আর্মেনীয়দের ওপর আজেরিরা চড়াও হয়। আজারবাইজান থেকে আড়াই লাখ আর্মেনীয় পালিয়ে যায়। এ সময় আর্মেনীয়দের দখলকৃত মোট ভূমির পরিমাণ ছিল আজারবাইজানের মোট ভূমির ২০ শতাংশ। আর্মেনিয়া নাগর্নো-কারাবাখে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ নামে একটি স্বাধীন, কিন্তু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত রাষ্ট্র স্থাপন করে। যদিও জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র আর্তসাখকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অঞ্চলটি আজারবাইজানের বলে স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আর্মেনিয়ান বাহিনীকে আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করলেও সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করে আর্মেনিয়া। আমেরিকা, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যস্থতায় দশকের পর দশক আলোচনা হলেও শান্তিচুক্তি অধরা থেকে গেছে।নাগার্নো-কারাবাখ সমস্যাটি আজারবাইজানের জনসাধারণের কাছে অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। বিষয়টি তাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত ছিল। আজারবাইজানের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল নাগার্নো-কারাবাখ ও আশপাশের আজারবাইজানি অঞ্চল পুনরুদ্ধারের পক্ষে ছিল। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে আর্মেনিয়ার বারবার পরাজয় ও দেশ হারানোর বেদনা আজেরি জনগোষ্ঠী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। প্রসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ নিজেও নাগার্নো-কারাবাখসহ দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। বিপুল তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আজারবাইজান রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক, ইসরাইল ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ক্রয় করতে থাকে। প্রায় ৬-৭ বছর ধরে তুরস্কের কাছ থেকে ব্যাপক মাত্রায় সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে আজেরি বাহিনী একটি সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীতে পরিণত হয়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ৪ দিনব্যাপী একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষই নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি করলেও কার্যত আজারবাইজান ৮ থেকে ২০ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধ আজারবাইজানিদের নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি আক্রমণ পরিচালনা করতে উৎসাহিত করে। ২০২০ সালের মে মাসে আর্তসাখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আরায়িক হারুতিউনিয়ান প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে একের পর এক উস্কানিমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তায় আজারবাইজান নাগার্নো-কারাবাখ পুনরুদ্ধার অভিযান শুরু হয়। আর্মেনিয়ার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। দু’মাস ধরে চলা যুদ্ধ শেষে ওই বছর ১০ নভেম্বর রাশিয়ার মধ্যস্থতায় দেশ দুটির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক রাশিয়া নাগার্নো-কারাবাখে আড়াই হাজার শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলটি মুক্ত করার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার মুহূর্তে আজারবাইজানের জন্য যুদ্ধবিরতির চুক্তি কিছুটা লোকসানের মতো হলেও চুক্তিতে লাভ হয়েছিল আজারবাইজানের; সঙ্গে তুরস্কেরও।

২০২০ সালের যুদ্ধে নিরাপত্তা চুক্তি মোতাবেক সামরিক সহায়তা না পাওয়ায় আর্মেনিয়া রাশিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। রাশিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্রতা শীতল সম্পর্কে রূপ নিতে থাকে। গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান এক বিবৃতিতে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকার সঙ্গে ১০ দিনব্যাপী সামরিক মহড়ার ঘোষণা দিলে নড়েচড়ে বসে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ আজারবাইজান মাইন বিস্ফোরণে ৬ সেনার মৃত্যুর অভিযোগে নাগার্নো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একটি ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরু করার কথা জানালেও এ অভিযানের পেছনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করেন। অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার বিবৃতিও ছিল সাদামাটা। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নাগার্নো-কারাবাখে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করতে দু-পক্ষই যেন সংঘর্ষ বন্ধ করে এবং সাধারণ মানুষ যেন হতাহত না হয়। পক্ষান্তরে আগে আজারবাইজানকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের বক্তব্য ছিল বেশ জোরালো। তিনি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে কথা বলে অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ রাখতে বলেন। অন্যদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিবৃতি ছিল বরাবরের মতো। তিনি ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দেন, নাগার্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের অংশ এবং সেখানে আঞ্চলিক সংহতি রক্ষা করতে যে কোনো অভিযানের অধিকার আজারবাইজানের আছে। তিনি তুরস্ক যে কোনো পরিস্থিতিতে আজেরি ভাইদের পক্ষে দাঁড়াবে বলে সাফ জানিয়ে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, আজারবাইজানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দুটো দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘এক জাতি, দুই দেশ’ এ নীতিতে বিশ্বাসী। শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ে নয়, তুরস্ক ও আজারবাইজানের সাধারণ জনগণও পরস্পর একই জাতি বলে মনে করে। যদিও তারা কখনও এক রাষ্ট্রের নাগরিক ছিল না। তারপরও তুর্কি ও আজেরিরা বিশ্বাস করে, তাদের উৎস এক এবং তারা একই রক্ত, ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরসূরি। তারা নিজেদের শুধু বন্ধু হিসেবে মনে করে না, বিশ্বাস করে তারা একে অপরের ভাইবোন। অটোমান সাম্রাজ্যের একেবারে শেষের দিকেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে আজেরিরা তুরস্কের সঙ্গে বেশি আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করায় সোভিয়েত পরবর্তী শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত আজারবাইজানে ইরানের শিয়া মতাদর্শ তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এরদোগানের শাসনের শুরু থেকেই রাজধানী বাকুসহ বিভিন্ন স্থানে তুরস্কের বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে মসজিদণ্ডইসলামিক সেন্টার গড়ে ওঠায় আজারবাইজানে সুন্নিদের প্রভাব বাড়তে থাকে দিনদিন।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত