চীনের পছন্দ হলেও ভারতের আপত্তি যে প্রকল্পে
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তিস্তা নদীতে বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের জন্য চীন তৎপর; কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে সেটি আটকে আছে। বর্তমান সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রকল্পটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দু’সপ্তাহ আগে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার বিষয়ে তিনি আশাবাদী। নির্বাচনের পরে চীনের রাষ্ট্রদূত তার সেই আগ্রহ চাপা রাখেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের দিক থেকে প্রকল্পের প্রস্তাব পেলে চীন সহযোগিতা দেবে; কিন্তু তিস্তা নদীর ওপর এ প্রকল্প নিয়ে ভারত এবং চীন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেককেই ধারণা করেন, ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগুতে পারছে না বাংলাদেশ। মোটকথা, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহের কারণ : পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ মূলত কৌশলগত। এ প্রকল্পটিকে চীন ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। হিমালয়ে উৎপত্তির পর তিস্তা নদী ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দু’দেশের অর্থনীতির জন্যই এ নদী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহী হয়ে ওঠার বড় কারণ হচ্ছে, তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রজেক্ট। বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে একই সুতোয় গাঁথতে চাইছে। চীনের বিআরআই প্রকল্পের আওতাধীন বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর। প্রস্তাবিত এ করিডোরের মাধ্যমে চীন তাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। এজন্য তিস্তা বহুমুখী প্রকল্পকে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, চীন প্রথম যেভাবে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ করতে চেয়েছিল, সেখান থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে। বিগত বছরগুলোতে ভারত ও চীনের সস্পর্ক নানা চরাই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
তিস্তা প্রকল্প সামনে এনেছিল যারা : তবে এ নিয়ে ভিন্নমতও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত তিস্তার অববাহিকা ঘুরে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ এখানে গৌণ এবং তাদের কোনো ভূরাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত নেই। তিস্তা নদীতে এটি বাংলাদেশের প্রকল্প, চীনের কোনো প্রকল্প নয়। চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে।
কারণ, অন্যরা সে অর্থ দিতে পারছে না। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে পারছে না, সেজন্য এর বিকল্প একটি সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ। এজন্য তিস্তা প্রকল্প সামনে এনেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অংশ তিস্তা নদীর অববাহিকায় উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের কৃষি ও মৎস্যসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড জড়িত। তিস্তা প্রকল্পের সঙ্গে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার নয় অধ্যাপক আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, কলকাতার সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি পদ্মা সেতুর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে সংযোগ কীভাবে হবে, এমন প্রশ্ন তোলা যায়। তিনি মনে করেন, যারা প্রবলভাবে ভারত কিংবা চীনবিরোধী, তারা এসব কথা বলছে।
ভারতের আপত্তির রহস্য : তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহকে ভারত বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। ভারত মনে করে, চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়। ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, তিস্তা প্রকল্পের যে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। তিনি বলেন, ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন সব প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীন অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করে। চীন তাদের উপস্থিতি জোরালো করতে চায়। তাছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিস্তা নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা প্রকল্পের আওতায় আছে- নদী খনন করে গভীরতা বাড়ানো, সারা বছর নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করা, নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ। এ প্রকল্প নিয়ে ভারতের আপত্তির বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। প্রথমত ভারত যদি এ প্রকল্পকে স্বাগত জানায়, তাহলে এখানে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগের প্রশ্ন উঠতে পারে। এ রকম একটা প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা ভালো। সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের ওপর চাপ বজায় রাখতে পারে। বলছিলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করেন, তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে গেলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের যে প্রভাব, সেটা আর থাকবে না। অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তখন আর ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই পাশে শহর গড়ে উঠবে, নদীশাসন হবে এবং নদীর নাব্য থাকবে। ফলে পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং দুই কোটি মানুষের জীবনও বদলে যাবে। এর ফলে সেখানে চীনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির পাশাপাশি ভারতবিরোধী মনোভাব আরো প্রবল হবে।
সত্যিই চীনের প্রভাব বাড়বে : বর্তমান সরকারের সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ভারতের সম্পর্ক বেশ ভালো থাকলেও দেশটিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে বলে ভারতের ভেতরে অনেকে মনে করেন। বিষয়টি নিয়ে ভারতের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিও আছে। এর আগে ২০২২ সালে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত যখন তিস্তা নদীতে সম্ভাব্য প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন, তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ সতর্ক হয়েছিল ভারত। ব্যাপারটিকে তারা ভালো নজরে দেখেনি। এ নিয়ে তখন ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছিল, শেখ হাসিনা যদিও বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী, তারপরও পানি সমস্যার সমাধান করার জন্য তিনি বিকল্প উপায়ও চিন্তা করছেন। দ্য টেলিগ্রাফ আরো লিখেছিল, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারতের কৌশলগত উদ্বেগও রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চীনের জোরালো উপস্থিতি থাকবে। কারণ, এর কাছাকাছি ভারতের উত্তরবঙ্গে ‘চিকেন নেক’ বা কম প্রশস্তের জায়গা রয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাকি দেশের সংযোগ রয়েছে। এত কাছাকাছি চীনের অবস্থান থাকলে সেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। গবেষক অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, যে জায়গাটিতে চীন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে, সেটি ভারতের স্পর্শকাতর এলাকার খুব কাছাকাছি। এটা সীমান্তের কাছাকাছি শুধু তাই নয়, শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সংযোগ স্থাপন করেছে এ শিলিগুড়ি করিডোর। সেজন্য এ জায়গা খুবই সংবেদনশীল।
চীনের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া সহজ নয় : ভারতের সাবেক ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন সম্প্রতি এক নিবন্ধে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ইলেকশনস অ্যান্ড ইট্স আফটারমাথ শিরোনামে সে নিবন্ধে পঙ্কজ সরন উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয় নীতি অনুসরণ করেছেন। যদিও চীনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে যাওয়া এবং আমেরিকার সঙ্গে শীতল সম্পর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টিতে সে নীতি ফুটে ওঠেনি। পঙ্কজ সরন আরো লিখেছেন, শেখ হাসিনার এবারের মেয়াদে চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এবং পশ্চিমের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে সে সম্পর্ককে উল্টোভাবে চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের আপত্তির মুখে তিস্তা প্রকল্প চীনের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না; এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী