ইসমায়েল ‘এল মায়ো’ জাম্বাডা; মাদক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে কুখ্যাত নামগুলোর অন্যতম। বিশ্বের সবচেয়ে প্রধান মাদক চোরাকারবারি চক্র বা ড্রাগ কার্টেলের ভয়াবহ শক্তিধর ব্যক্তিদের একজন। এ সাম্রাজ্যে ব্যাপক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই ড্রাগ কার্টেলের মাদক সম্রাটরা তাদের অবৈধ মাদক ব্যবসার আধিপত্য ধরে রাখতে এবং বেশি বেশি লাভ করতে একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে কাজ করত। বলা হয়, জাম্বাডা হলেন ড্রাগ কার্টেল নেতাদের প্রকৃত প্রজন্মের সবশেষ সদস্যদের একজন। উত্তর-পশ্চিম মেক্সিকোর শহর কুলিয়াকানে আসবাবপত্রের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করত। পরে ১৯৭০-এর দশকে একজন পাচারকারী হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্যারিয়ার শুরু। সাধারণ পাচারকারী থেকে জাম্বাডা এতটা উত্থান লাভ করায় তাকে ‘ক্যাপো দে ক্যাপোস’ (নেতার নেতা) বলা হয়। সে আরেক কুখ্যাত মাদককারবারি জোয়াকিন ‘এল চ্যাপো’ গুজম্যানের সঙ্গে ১৯৮৯ সালে সিনালোয়া কার্টেল নামে এক মাদক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ওই বছর গুয়াদালাজারা কার্টেল নামে একটি মাদককারবারি সংগঠন ধসে পড়েছিল। ওই সংগঠনের অবশিষ্টাংশ থেকে নতুন করে সিনালোয়া কার্টেল প্রতিষ্ঠা পায়।
গ্রেপ্তারের সূচনা গল্প : জাম্বাডা শুরুতে গুয়াদালাজারা কার্টেলের জন্য কাজ করত। ওই প্রতিষ্ঠানটি আফিম, গাঁজা এবং সবশেষ কোকেনের ব্যবসা করত। তার কুখ্যাত সহচর এল চ্যাপো যেখানে দু’বার জেল খেটেছে এবং জেল থেকে পালিয়েছে, সেক্ষেত্রে জাম্বাডার গল্প একদম ভিন্ন। সে প্রায় ৩৫ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার টেক্সাসের এল পাসো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করে। মার্কিন আইনপ্রণেতারা ফেব্রুয়ারিতে জাম্বাডার বিরুদ্ধে ফেন্টানাইল তৈরি ও বিতরণের অভিযোগ আনে। যা কি না হেরোইনের চেয়েও শক্তিশালী একটি মাদক। যা আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে সিনথেটিক ওপিওডের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার, খুন, অপহরণ, মানি লন্ডারিংসহ আরো নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে সে তার বিরুদ্ধে আনা এসব একাধিক অভিযোগে টেক্সাসের ফেডারেল আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে। জাম্বাডাকে মূলত ছলে-বলে কৌশলে একটি ব্যক্তিগত বিমানে তোলা হয়। জাম্বাডা ভেবেছিল, সে দক্ষিণ মেক্সিকোতে একটি গোপন বিমান ওঠানামার স্থান পরিদর্শন করতে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে এল পাসো শহরে টেক্সাসের বাইরে একটি ব্যক্তিগত বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে গোপন ফাঁদ পেতে চালানো অভিযানে তাকে কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তার সাবেক সহযোগী এল চ্যাপোর ছেলে। বিমান অবতরণের পর মার্কিন কর্মকর্তারা জাম্বাডার পাশাপাশি এল চ্যাপোর ছেলে এবং তার অন্যতম উত্তরাধিকারী ৩৮ বছর বয়সী জোয়াকিন গুজমান লোপেজকেও গ্রেফতার করে। মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজের প্রতিবেদক ব্রায়ান লেনাস বলেছেন, লোপেজ মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জাম্বাডাকে ধরিয়ে দেয়। কারণ, সে তার বাবাকে (এল চ্যাপো) গ্রেপ্তারের পেছনে জাম্বাডাকে দায়ী করে। এল চ্যাপোর বিচার চলাকালীন তার আইনজীবীরা জাম্বাডার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছিল, জাম্বাডা কোনো ভয় ছাড়া যেন খোলামেলা জীবনযাপন করতে পারে, তার জন্য পুরো মেক্সিকান সরকারকে ঘুষ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী বাহিনী ইউএস ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) জাম্বাডাকে ধরার জন্য দেড় কোটি ডলার পর্যন্ত পুরস্কারের ঘোষণা করেছিল।
জাম্বাডার জেল-হাজতের ভয় : ‘আপনি যে কোনো সময় ধরা পড়তে পারেন, এ ভেবে কী আপনি চিন্তিত?’ জাম্বাডাকে ২০১০ সালে এ প্রশ্নটি করেছিলেন প্রয়াত মেক্সিকান সাংবাদিক জুলিও শেরার গার্সিয়া। এ মাদক সম্রাটের এক বিরল সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য তিনি পাহাড়ের গহিনে গিয়েছিলেন। ‘আমাকে জেলে পাঠাতে পারে, এ ভাবনায় আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই।’ জাম্বাডা উত্তরে বলেছিল। ‘আমি জানি না যে, তখন আমি কীভাবে আত্মহত্যা করব। আমার মনে হয়, আমি তাই করব এবং আমি আমার নিজের জীবন নেব।’ সে যখন আসলেই গ্রেপ্তার হলো, তখন তার কাছে আত্মহত্যা করার উপায় বা সুযোগ কোনোটাই ছিল না। জাম্বাডা এত বছর ধরে এতটা সতর্ক থেকেছে, তার মতো মানুষের ৭৬ বছর বয়সে এসে ফাঁদে পা দেয়া একটি অসাধারণ ঘটনা বলেই ধরে নেয়া যায়। তাকে গ্রেপ্তার করতে এবং কারাগারে নিতে এ রকম অভিনব কিছুরই প্রয়োজন ছিল। প্রাক্তন ডিইএ এজেন্ট মাইক ভিজিল বলেছেন, আমি অবাক হই না যে, জাম্বাডাকে এতদিন ধরা যায়নি। তার বয়স এখন ৭০-এর কোঠায়। স্বাস্থ্যের অবস্থা তেমন ভালো নয়। সে এরই মধ্যে বলেছে, কারাগার তার সবচেয়ে ভয়ের জায়গা। এ গ্রেপ্তারের ঘটনা এবং এল চ্যাপোর ছেলেরা যারা কি না, লস চ্যাপিটোস নামে পরিচিত তাদের সঙ্গে মার্কিন সরকারের সম্ভাব্য আবেদনের চুক্তি একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে যে, সিনালোয়া কার্টেলের নিয়ন্ত্রণ কারা নেবে। লস চ্যাপিটোস হলো এল চ্যাপোর সন্তানদের নিয়ে গঠিত সেল। যার অর্থ ক্ষুদে চ্যাপোরা। এল চ্যাপো গুজম্যানকে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করার পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর থেকে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদক ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। ব্যাপক রক্তপাত হয়। সেই সঙ্গে বিরোধী বিভিন্ন মাদক চক্র যারা কি না, কিছুটা দুর্বল তাদের বিরুদ্ধেও তুমুল লড়াই শুরু করে তারা। সিনালোয়া কার্টেলের নেতা ওভিডিও গুজমান লোপেজ যখন ২০১৯ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হয়, তখন প্রতিষ্ঠানটির বন্দুকধারীরা যেভাবে এর জবাব দিয়েছিল, তা ছিল ভীষণ মর্মান্তিক ও হিংসাত্মক। ওভিডিওকে আটক করার পর শত শত বন্দুকধারী কুলিয়াকান শহরে নেমে আসে। পয়েন্ট ৫০ ক্যালিবার অস্ত্র এবং রকেট লঞ্চার দিয়ে বেসামরিক নাগরিক, পুলিশ এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বেপরোয়া হামলা চালায়। অবশেষে যুদ্ধের ইতি টানতে কর্তৃপক্ষ ওভিডিও গুজম্যানকে তার লোকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। প্রত্যর্পণ করা হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে সে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
কিংপিন কৌশল ও তার ফলাফল : মাইক ভিজিল মনে করেন, কুলিয়াকান শহরে যে সহিংসতা হয়েছিল, যা কুলিয়াকানাজো নামে পরিচিত, এমন সহিংস পরিস্থিতি আজকের সময়ে এড়ানো যেতে পারে। সিনালোয়া কার্টেলের সম্ভাব্য নেতাদের খুব শক্তিশালী একটি বেঞ্চ রয়েছে। যেখানে এল চ্যাপোর ভাইও আছে। যারা প্রতিষ্ঠানটির পরবর্তী দায়িত্ব নিতে পারে। ভিজিলের দাবি, কিংপিন কৌশল খুব একটা সফল হয়নি। কিংপিন কৌশল মূলত এমন এক ধরনের কৌশল, যেখানে মাদককারবারি সংগঠনগুলোর প্রতিটি কার্টেল নেতাদের দমাতে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তৎকালীন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফেলিপ ক্যালডেরনের প্রশাসনের অধীনে এ কৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদক কার্টেলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তৈরি করা হতো। ফলে প্রচুর রক্ত ঝরেছিল। যদি এখনকার সময়ে এমনটা হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে শুধু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জলিসকো নিউ জেনারেশন কার্টেল (সিজেএনজি) বিজয়ী হবে।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিশ্রুতি : সাম্প্রতিক এসব ঘটনাপ্রবাহ এবং এখন যে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, এমন অবস্থায় মেক্সিকোর দলগুলোর মধ্যে কি ধরনের ক্ষমতার লড়াই শুরু হবে, তা বলা যাচ্ছে না। মেক্সিকান কর্তৃপক্ষ সহিংসতা শুরু হওয়ার আগেই সিনালোয়া রাজ্যে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছে। জাম্বাডাকে গ্রেপ্তারের এ অভিযানটি কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়ার বিষয়ও ছিল। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে শুরু থেকেই এ অভিযান নিয়ে অনেক সংশয় ছিল। কিন্তু যখন তাদের এ পরিকল্পনার বিভিন্ন কৌশল একে একে জোড়া লাগতে থাকে, তখনই তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এ অভিযান চালাবে। কেন না, এ চেষ্টার ফলে তাদের কিছুই হারাতে হবে না। এ অভিযান সফল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ সময়। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডের এক ভিডিও বার্তায় গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমাদের দেশ যত হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে ফেন্টানাইল সবচেয়ে মারাত্মক। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, আমাদের সমাজে যারা এই বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে, এমন প্রতিটি কার্টেল নেতা, সদস্য এবং সহযোগীদের কাঠগড়ায় দাঁড় না করা পর্যন্ত মার্কিন বিচার বিভাগ বিশ্রাম নেবে না।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ : বর্তমানে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সি আমেরিকানদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ফেন্টানাইল ওভারডোজ বা অতিরিক্ত ফেন্টানাইল প্রয়োগ। এটি এমনই এক বিস্ময়কর পরিসংখ্যান, যার কারণে বাইডেন প্রশাসনও নির্বাচনের বছরে এ ঘটনায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। লস চ্যাপিটোস (এল চ্যাপোর ছেলেরা) এবং এল মায়ো জাম্বাডা সবাই ফেন্টানাইলের মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার উপার্জন করেছে। এ ফেন্টানাইল উৎপাদন এবং পরিবহন করা বেশ সহজ। কোকেন তৈরির মতো আন্দিজে বড় কোকা বাগান করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেন্টানাইলের চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করা কার্যত অসম্ভব। এটি কার্টেলদের কাছে খুব লাভজনক ব্যবসা এবং মেক্সিকোর মাদক যুদ্ধের আধুনিক প্রেক্ষাপটে এটি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। যা-ই হোক, মার্কিন আইন প্রয়োগকারীরা ফেন্টানাইলের উৎপাদন রোধে এমন কার্টেলগুলোকে দমন করতে চায়। তাদের প্রভাব কমিয়ে আনতে চায়। যেখানেই সম্ভব, তাদের নেতৃত্বকে ভেঙে দিতে চায়। এল মায়ো জাম্বাডাকে গ্রেপ্তার করা (সেটি তার বুড়ো বয়সে হলেও, দুর্বল স্বাস্থ্যে এবং তারই লোকজনের সহায়তায় হলেও) এ কৌশলটির সব সময় গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মতে, জাম্বাডা মেক্সিকোতে একটি বড় দুধ কোম্পানি, একটি বাস পরিবহন কোম্পানি এবং একটি হোটেল আর সেই সঙ্গে রিয়েল এস্টেটসহ বেশ কয়েকটি বৈধ ব্যবসারও মালিক।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী