হালাল উপার্জনের উপকারিতা
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোমিন জীবনে হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সব ধরনের ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য জীবিকা হালাল হওয়া অপরিহার্য। হালাল অর্জন এবং হারাম বর্জনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের ইহ-পরকালীন আসল সফলতা, প্রকৃত কল্যাণ। ইসলামের নির্দেশনা হলো, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি যেমন ইবাদত, তেমনি হালাল রুজি অর্জনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এসব যেমন অকাট্য ফরজ, হালাল পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করাও অলঙ্ঘনীয় ফরজ। তাই একজন মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয়, আয়-ব্যয়, কর্মক্ষেত্র, বাসস্থান ও গৃহ নির্মাণ- সব ক্ষেত্রে হালালকেই গ্রহণ করবে এবং হারাম ও সন্দেহযুক্ত বস্তু থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।
হালাল-হারামের সংজ্ঞা : হালালের আভিধানিক অর্থ হলো, মুবাহ বা বৈধ। পরিভাষায়- শরিয়ত অনুমোদিত এবং নিষেধাজ্ঞার বন্ধনমুক্ত বস্তুকে হালাল বলা হয়। আর হারাম হচ্ছে, যা শরিয়তপ্রণেতা কর্তৃক অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য। পৃথিবীর সব বস্তুই মৌলিকভাবে বৈধ। তবে মহান আল্লাহ এবং রাসুল (সা.) যদি কোনো বস্তুকে হারাম বলে ঘোষণা করেন, তবেই তা হারাম বলে গণ্য। মহানবী (সা.) হালাল-হারামকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ‘আল্লাহতায়ালা স্বীয় কিতাবে যেসব জিনিস হালাল করেছেন, তা হালাল এবং আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাবে যেসব জিনিস হারাম করেছেন, তা হারাম। আর যেসব বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন, তা তিনি ক্ষমা করেছেন।’ (তিরমিজি : ১৭২৬)।
হালাল বস্তুর দুই শর্ত : যে কোনো বস্তু হালাল বা পবিত্র হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে- প্রথমত ব্যবহার্য, ভোগ্য বা উপভোগ্য বস্তুটি হালাল তথা পবিত্র ও অনুমোদিত হতে হবে। দ্বিতীয়ত তা অর্জনের পথ বা মাধ্যমও বৈধ হতে হবে। এ দু’য়ের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে বস্তুটি হারাম বলে বিবেচিত হবে। বেদনার কথা হলো, অনেক প্র্যাক্টিসিং মুসলিম খাবার-দাবার এবং ভোগ-উপভোগের বস্তু কেনার ক্ষেত্রে হালাল-হারামের খোঁজ করলেও তা অর্জনের পন্থায় হালাল-হারামের যাচাই করে না। প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার পয়সা হালাল কি-না, সেটার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। যেমন- গরুর গোশত হলে খায়, শূকরের গোশত হলে খায় না; কিন্তু গরুর গোশত কেনার টাকাগুলো বৈধ পন্থায় উপার্জন করেছে নাকি অবৈধ পন্থায় হাতিয়ে নিয়েছে, তা ভাবার প্রয়োজন মনে করে না। অথচ উভয়টিই সমান গুরুত্ব রাখে। তাইতো প্রাচুর্যের অট্টালিকায় বাস করেও মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পায় না। কেননা, সুখময় জীবন লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, হালাল রিজিক। বিশ্বমানবতার নিঃস্বার্থ বন্ধু মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে, তখন দুনিয়ার অন্য সবকিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। তা হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনে খাদ্যগ্রহণ।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬৫২)।
হালাল-হারামের জ্ঞান রাখা আবশ্যক : চলমান জীবনের বহমান স্রোতধারায় প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মোমিন যখন যে অবস্থার সম্মুখীন হবে, যে বিধান তার ওপর আরোপিত হবে, তখন ওই বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান রাখা তার জন্য ফরজ। যাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইলমুল হাল’ বলা হয়। যেমন- কারও ওপর নামাজ ফরজ হলে নামাজের মৌলিক মাসআলা জানা, ব্যবসা-বাণিজ্য করলে এর বিধিবিধান জানা, চাকরি করলে কর্মক্ষেত্রে শরিয়তের আহকাম জানা, বিয়ে করলে এ সংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান রাখা তার জন্য আবশ্যক। হালাল-হারামের মৌলিক জ্ঞান রাখা প্রত্যেক মোমিনের জন্য ফরজ। আহমদ বিন আহমদ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হারামণ্ডহালাল জানা ফরজ; যাতে তিনি দ্বীনের ব্যাপারে এমন জাগ্রত জ্ঞানসম্পন্ন হন, যেন নিষিদ্ধ বিষয়ে পতিত না হন এবং ইসলামি বিধানের বিরোধিতা না করেন।’ (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি তালাবির রিজক : ১১)।
হালাল জীবিকা নির্বাহ করা ফরজ : একজন মোমিনকে যেমন তার যাপিত জীবনে বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, মেলামেশা, আখলাক- সবক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলতে হয়, তেমনিভাবে জীবনোপকরণ এবং জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত বিধি-নিষেধের আওতায় থাকতে হয়। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ ভোগ-উপভোগের রকমারি উপকরণ সবই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত। আর রিজিকের সঙ্গে হালাল-হারামের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হালাল উপার্জনের নির্দেশ প্রদান করে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা পৃথিবী থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইসলামি স্কলার ও বিদ্বানদের কিছু অমূল্য অভিমত তুলে ধরেছেন। সাহল বিন আবদুল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘তিনটি বস্তু মুক্তির উপায়- হালাল খাবার গ্রহণ করা, ফরজগুলো আদায় করা এবং নবী করিম (সা.)-এর অনুসরণ করা।’ সাঈদ বিন ইয়াজিদ (রহ.) বলেন, ‘আমল পরিপূর্ণতা লাভ করে পাঁচটি গুণে। তা হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান, সত্যের পরিচয় লাভ, আল্লাহর জন্য ইখলাসপূর্ণ আমল, সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপন ও হালাল খাদ্য গ্রহণ। আর এর একটিও নষ্ট হলে আমল কবুল হবে না।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ২/২০৮)। কারণ, কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে; কিন্তু সত্যের পরিচয় তার সামনে স্পষ্ট না থাকে, ঈমান দ্বারা সে যথাযথ উপকৃত হতে পারবে না। সত্যের পরিচয় পেল, কিন্তু ঈমান আনল না; সেও পথভ্রষ্ট। ঈমান আনল, সত্যও চিনল, কিন্তু আমলে ইখলাস নেই; সেও প্রবঞ্চিত। আগের চারটি বিদ্যমান; কিন্তু খাবার হালাল নয়, তার ইবাদতও কোনো কাজে আসবে না। হালাল উপার্জন অন্যতম ফরজ ইবাদত। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল জীবিকা সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজসমূহের পরে বিশেষ একটি ফরজ।’ (সুনানে বায়হাকি : ৬/১২৮)।
হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত : ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য উপার্জন হালাল হওয়া অপরিহার্য। সমাজ জীবনে অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা ইবাদতের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-সদকা সবক্ষেত্রেই অগ্রগামী। কিন্তু এসব ইবাদত শত কষ্ট ও ধৈর্যসহ করলেও তাদের উপার্জন ও রিজিক হালাল না হওয়ায় সব ভেস্তে যায়। রিজিক হালাল না হলে বান্দার দোয়াও কবুল হয় না। মুসলিম শরিফে আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে একটি বর্ণনা আছে, যা ইবাদত ও দোয়া কবুল হওয়ার জন্য পানাহার ও পোশাক হালাল হওয়ার আবশ্যকীয়তার ওপর সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মোমিনদেরও সেই আদেশ করেছেন, কোরআনে যে আদেশ করেছেন তার রাসুলদের। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর ও সৎকর্ম কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। ঈমানদারদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘হে মোমিনরা! আমার দেওয়া রিজিক থেকে পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। এরপর রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির আলোচনা করলেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে। চুল উস্কোখুস্কো। বদন ধূলিমলিন। সে আকাশের দিকে হাত প্রসারিত করে ডাকে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় হারাম, লালিত-পালিতও সে হারাম খাবারে। ফলে কী করে তার দোয়া কবুল হতে পারে? (মুসলিম : ১০১৫)।
জীবনযাপনে হালাল পানাহারের প্রভাব : মানুষের পেটে যা পড়ে, মন-মেজাজে ও আচরণে তার প্রভাব থাকেই। শরীরের সঙ্গে যা আহার্য হিসেবে মিশে যায়, বাহ্যিকভাবেও তার বিরাট ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। হালাল পানাহারের যেমন শারীরিক প্রভাব রয়েছে, রয়েছে আত্মিক প্রতিক্রিয়াও। এর মাধ্যমে হৃদয় আলোকিত হয়, অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, ইবাদতে একাগ্রতা হাসিল হয়। ব্যবহার্য সামগ্রী ও ভোজ্য খাবার হালাল হলে মন-মননে সৃষ্টি হয় নেক আমলের প্রতি দুর্বার আগ্রহ ও উদ্দীপনা। ফরজের সঙ্গে নফলের প্রতিও জাগে প্রেরণা। দূরীভূত হয় পারিবারিক কলহ ও অশান্তি। হালালের প্রভাব যেমন ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে রয়েছে, রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও। এতে দেশে সৎ নিষ্ঠাবান ও আল্লাহভীরু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে রাষ্ট্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম হ্রাস পায়। কমে আসে অশ্লীলতা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, হত্যাকাণ্ড, মাদকদ্রব্য, চুরি-ডাকাতি, সুদণ্ডঘুষ, কালোবাজারি, ওজনে কম দেওয়া, দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া, ছিনতাই, জুয়া, গুদামজাতসহ যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচারের হার। এতে দেশে প্রবাহিত হয় শান্তির সুবাতাস। বিদায় নেয় অবক্ষয়ের করাল গ্রাস। আর যদি হালালের বিপরীতে হারামের জয়জয়কার হয়, তাহলে পরিণামে ধেয়ে আসে বিনাশ ও অধঃপতনের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। নেমে আসে জীবন বিধ্বংসী কালবোশেখি ঝড়। জাতির কপালে জোটে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে হালাল খাবারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে রাসুলরা! তোমরা পবিত্র বস্তু আহার কর ও সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, তা সম্পর্কে আমি অবগত আছি।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। আয়াতে প্রথমে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণের নির্দেশের দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, হালাল খাবারের সু-ক্রিয়াতেই ভালো কাজের আগ্রহ জন্মে। কারণ, হালাল ও পবিত্র আহার্য শরীর ও মন উভয়কেই শুদ্ধ করে। ফলে শারীরিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি চারিত্রিক উৎকর্ষও সাধিত হয়।
হারাম ভক্ষণে জান্নাতে প্রবেশে বাঁধা : মহান আল্লাহই মানুষের জন্য জমিনে রিজিকের বিভিন্ন উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। জমিনকে নরম ও উর্বর করে সৃষ্টি করেছেন। যাতে মানুষ সহজেই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। রবের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে। পবিত্র কোরআনে তিনি চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য জমিনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে-প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিজিক থেকে আহার কর। আর তাঁর কাছেই তোমাদের পুনরুত্থান।’ (সুরা মুলক : ১৫)। ভয়ের কথা হলো, হারাম ভক্ষণকারী জান্নাতে প্রবেশ না করার কঠিন হুঁশিয়ারিও এসেছে হাদিস শরিফে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৭৮৭)। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম মাল দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম দ্বারা গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৭৭২)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া
হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম