কুর্দিদের ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯২৩ সালে কুর্দিদের বিভক্ত করার পর সবচেয়ে বেশি কুর্দিদের ঠাঁই হয় তুর্কিতে। শুরু থেকেই মোস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক কুর্দিদের ভাষা-সংস্কৃতিকে কঠোর হাতে দমন করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি জোর করে তাদের কুর্দি পরিচয়ের স্থলে তুর্কি পরিচয়কে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। কুর্দি নাম এবং সংস্কৃতিতেও আনা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। কুর্দিদের ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। তাদের কুর্দি নামে না ডেকে ডাকা হতো ‘পার্বত্য তুর্কি’ বলে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কুর্দিদের মাতৃভাষা তুরস্কে নিষিদ্ধ ছিল। এ সময়ে কুর্দিরাও বসে ছিল না। ১৯২৩ সালের পর থেকে স্বাধীন কুর্দি প্রতিষ্ঠার দাবিতে কুর্দিরা বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ করে। কিন্তু তুর্কি শাসকরা তা কঠোর হাতে দমন করে। ১৯৭৮ সালে কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওকালান কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) গঠন করে তুরস্কের অভ্যন্তরেই এক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। এতে প্রায় ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়। ১৯৯০ সালে পিকেকে তাদের স্বাধীনতার দাবি থেকে পিছিয়ে এসে তুর্কি সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসে। কুর্দিরা তাদের দাবি পাল্টে বলে, তারা এমন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ চায়; যেখানে থাকবে তাদের নিজেদের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা। তুর্কি সরকার এ দাবি মেনে নিলে ১৯৯১ সালে সম্পাদিত হয় কুর্দি আর তুরস্ক সরকারের মাঝে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি। অবসান হয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের। পিকেকে তুর্কির মূল স্রোতে একীভূত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বর্তমানে তুর্কি পার্লামেন্টে তাদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। কিন্তু তারপরও নিজ দেশের কুর্দিদের নিয়ে তুর্কি সরকারের ভয়ের যেন শেষ নেই।

শুধু তুরস্কের অভ্যন্তরেই নয়, আশপাশের অন্য কোনো রাষ্ট্রেও কুর্দিরা যাতে কোনোভাবেই স্বাধীনতার স্বাদ পায়, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক তুর্কি সরকার। কারণ, এমনটি ঘটলে তার ঢেউ তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলেও আছড়ে পড়তে পারে। এতে করে কৌশলগত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তুর্কি সীমান্তবর্তী সিরিয়ার কুর্দিদের নিয়ে তুরস্কের এত ভয়। ২০১৫ সালের শেষের প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থনে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুর্কি সীমান্তবর্তী এলাকায় আসাদবিরোধী সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার নির্বিচারে বিমান হামলার পাশাপাশি আসাদ বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করলে তুরস্ক অভিমুখে সিরিয়ান শরণার্থীর ঢল নামে। সর্বশেষ হিসেবমতে, তুরস্কে আশ্রিত সিরীয় শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এ সুযোগে বিরুদ্ধে আমেরিকার হয়ে আইএস বিতাড়নে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আমেরিকার ওই এলাকায় একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের তোড়জোড় শুরু করে দিলে আসাদের চেয়ে বেশি বিচলিত হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এরদোয়ানের আশঙ্কা ছিল, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিজ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার কুর্দি বাসিন্দাদের মাঝে স্বাধীনতার স্পৃহা পুনরায় জাগ্রত করতে পারে। শরণার্থীদের সিরিয়ায় ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো উদ্যোগ না দেখে এবং আমেরিকার অভিসন্ধি আঁচ করতে পেরে এরদোয়ান ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পরপর তিনটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে কুর্দিদের নিজ সীমান্ত থেকে বিতাড়ন, সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের অভ্যন্তরে ৩২ কিলোমিটার, প্রস্থে ৪৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি ‘বাপার জোন’ গঠন করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

ইরাকি কুর্দিদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় অনেকটা ভালো। এ ভালো হওয়ার পেছনে তাদেরকে লড়াই-সংগ্রামও করতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৯২৩ সালে ইরাকিদের অধীনে যাওয়ার পর থেকেই কুর্দিরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিল। ১৯৪৬ সালে কুর্দিরা ইরাকের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য মাসুদ বারজানির নেতৃত্বে কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি) গড়ে তোলে। তাদের আন্দোলনের মুখেই ইরাকি সরকার কুর্দিদের নাগরিকত্ব দান করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে নানা চরাই-উতরাই পেরিয়ে সাদ্দামের যুগে প্রবেশ করে। সাদ্দামের সঙ্গেও তাদের বিরোধ বাধে। ফলে ইরান-ইরাক যুদ্ধে কুর্দিরা ইরানকে সমর্থন দেয়। ১৯৮৮ সালে সাদ্দাম হোসেন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কুর্দি দমনে উঠেপড়ে লেগে যান। এমনকি তিনি রাসায়নিক বোমার মাধ্যমে ধ্বংস করেন গ্রামের পর গ্রাম। এতে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক কুর্দি নিহত হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে আটক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছিল কয়েকটি কুর্দি সংগঠন। এ সময়ে কুর্দিস্তানে আঞ্চলিক সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার দোহুক, ইরবিল এবং সুলাইমানিয়া প্রদেশে শাসনের অনুমতি পায়। মাসুদ বারজানি সেই অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত হন এবং জালাল তালেবানি প্রথম ইরাকবহির্ভূত প্রাদেশিক প্রধান বলে নিয়োজিত হন। ১৯৯১ সালে ইরাকি কুর্দিরা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। এরপরই তারা স্বাধীনতার জন্য নতুন করে সোচ্চার হয়ে ওঠে। যার ফলে ২০১৭ সালে কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট হয়। এ গণভোটে ৯২ শতাংশ কুর্দিরা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়; কিন্তু ইরাকি সরকার এ গণভোটকে অবৈধ বলে আখ্যা দেয় এবং তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আমেরিকা গণভোটের বিপক্ষে কথা বলে। ফলে ইরাকি কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রশ্ন এবারও আটকে যায়।

২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ শুরুর আগপর্যন্ত কুর্দিরা দামেস্ক, আলেপ্পো, কোবেন, আফরিন এবং কামিশলি শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাস করত। সিরিয়ান কুর্দিদের বহুকাল ধরে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে সিরীয় সরকার। ১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ কুর্দিকে সে দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। তাদের অনেক জমি জোরপূর্বক দখলও করা হয়েছে। গণজাগরণের শুরুতে কুর্দিরা কোনো পক্ষের সমর্থন করেনি। ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় আইএস-এর উত্থান ঘটলে এবং আসাদ বাহিনী পিছু হটলে কুর্দি দলগুলো আমেরিকার সাহায্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আইএসকে হটিয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৪ সালে ডমিন্যান্ট ইউনিয়ন পার্টিসহ কয়েকটি কুর্দি দল ঘোষণা দেয়, তারা আফরিন, কোবেন এবং জাজিরায় স্বায়ত্তশাসন চালু করতে চায়। ২০১৬ সালের মার্চে তারা আরো ঘোষণা করে, সিরিয়ার যে অঞ্চলগুলো আইএস-এর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে, সেখানে নিজেদের সরকারব্যবস্থা চালু করবে। কিন্তু এ ঘোষণায় সিরিয়ান সরকার প্রত্যাখ্যান করে। নিজের গদি রক্ষায় যেখানে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, সেখানে সীমান্তবর্তী এলাকায় সিরীয় কুর্দিদের এমন তৎপরতার বিরুদ্ধে বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। সিরিয়ার অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করে কুর্দিদের সেই স্বপ্ন বানচাল করে দিয়েছিলেন এরদোয়ান; সেই কথা আগেই বলা হয়েছে। যদিও আসাদ সরকার তুর্কি বাহিনীর এ অভিযানকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে এরদোয়ানের নিন্দা জানিয়েছিল। ইরানের কুর্দিদের অবস্থাও একই। ইরান যেহেতু শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল, তাই সুন্নি কুর্দিরা এখানে উপযুক্ত মর্যাদা পাবে না, এটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরতে হবে। বাস্তবতাও তাই। ইরান সর্বদা কুর্দিদের ওপর তীক্ষè নজর রাখে। তাদের দাবি-দাওয়া কঠোর হাতে দমন করে। ফলে ইরানে কুর্দিরা শোষণ আর বঞ্চনার প্রতীক হয়েই আছে। ইরানের কুর্দি জনগোষ্ঠীর মানুষ স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে পিডিআই নামের এক সশস্ত্রগোষ্ঠী। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে ২০২২ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সানান্দাজ কারাগারে ৪৮ বছর বয়সি হেইদার গোরবানি নামক এক কুর্দি বিদ্রোহী নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ইরান সরকার। এত আলোচনার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ অঞ্চলের কুর্দিদের ভবিষ্যৎ কী? আগামীতে কি ঘটবে তাদের ভাগ্যে? এসব প্রশ্নের আপাতত কোনো উত্তর না মেললেও এতটুকু বলা যায়, কুর্দিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন সুদূর পরাহত। দৈবিক কিছু না ঘটলে কুর্দিদের স্বাধীনতা লাভের আশা একেবারে নেই বললেই চলে। একমাত্র আলোচনাই পারবে এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এনে দিতে। যেখানে সব পক্ষই লাভবান হবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা না করেও কুর্দিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারবে।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক