ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল যুদ্ধের রহস্য

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল যুদ্ধের রহস্য

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে যত বিশ্লেষণ দেখা যাচ্ছে, এর কোনোটিই ঠিক পুরো গল্প বলছে না। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে আসলে কী ঘটছে, সেটা বের করাও কঠিন। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের নতুন চেহারা এখনও ফুটে ওঠেনি। এখনও ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা, সেটাও এখন পর্যন্ত খুবই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতা এর মধ্যেই কোথাও আছে, কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে হবে, সেসব নির্ভর করছে এ বছর ও পরবর্তীতে যুদ্ধটা কোন দিকে যায়, তার ওপর। এখানে কিছু জিনিস রয়েছে, যা আমরা জানি এবং কিছু আছে, যা জানা নেই। ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণের সময় কিছু লোক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ডকে ব্যঙ্গ করেছিল। কারণ, তিনি সেখানে অজানার কথা বলেছিলেন। পৃথিবীর এ অংশে সেগুলো খুব ভালোভাবেই আছে।

সাধারণ ইসরায়েলিদের ক্ষোভের কারণ : গাজায় হামাস ও তার অনুজ সঙ্গীকে নির্মূল করার জন্য যে সামরিক অভিযান চলছে, তাতে সাধারণ ইসরায়েলিদের সমর্থন আছে। তাদের ক্ষোভের পেছনে কারণ হলো, হামাসের অকস্মাৎ এক নজিরবিহীন হামলা; যা কেড়ে নেয় ১৪০০ মানুষের প্রাণ। একই সঙ্গে আরো ২৪০ জনকে বন্দি করে নিয়ে যায় গাজায়। ইসরায়েলের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নোয়াম তিবন এ কথা দাবি করে বলেন, ‘কোনো জাতিই মেনে নেবে না, তার প্রতিবেশী এসে তাদের শিশু, নারী ও মানুষদের হত্যা করবে। যেভাবে ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুদের খতম করেছিল, ঠিক সেটাই আমাদের এখন গাজায় করতে হবে। ক্ষমার সুযোগ নেই।’ কিন্তু যেসব নিরীহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছে, তাদের কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত এটা ঘটছে। আমরা কঠিন প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকি। আর টিকে থাকতে হলে আমাদেরও কঠোর হতে হবে।’ তিনি ছাড়া আরো অনেক ইসরায়েলি এ ভাবনা পোষণ করেন, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক।

ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যায় গরমিল : গাজায় হামাসের ওপর ইসরায়েলের হামলা ভয়াবহ রক্তপাত ঘটাচ্ছে। হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু। এটা পরিষ্কার নয় যে, যেসব মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে কতজন বেসামরিক নাগরিক আর কতজন হামাস বা ইসলামি যোদ্ধা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলিরাও স্বাস্থ্য মন্ত্রলায়ের এ হিসাব বিশ্বাস করে না। কিন্তু অতীতের সংঘাতগুলোতে ফিলিস্তিনি হতাহতের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, সেটা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারা নির্ভুল বলে গণ্য হয়। একটা মাইলস্টোন এখন চোখের সামনে। জাতিসংঘের হিসেবে ২১ মাস আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় ৯ হাজার ৭০০ জন বেসামরিক নাগরিক সেখানে মারা গেছে।

বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে জাতিসংঘের তথ্য : ফিলিস্তিনিদের কিছু মৃত্যুর মধ্যে হয়তো হামাসও আছে। কিন্তু সেটা যদি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশও হয়, যেটার সম্ভাবনা খুবই কম, তারপরও দেখা যায়, রাশিয়া ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যতজনকে হত্যা করছে, ইসরায়েলিরা ঠিক সেই পরিমাণ বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে যাচ্ছে ১ মাসের মধ্যেই। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেনের এ হিসাবটা অসম্পূর্ণ। বেসামরিক নাগরিক মৃত্যুর সংখ্যা আরেকটু বেশি হবে। এদিকে গাজার মৃতের সংখ্যাও বাড়বে। কারণ, অনেক ফিলিস্তিনি এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বলছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় এত বেশি পরিমাণ বেসামরিক নাগরিক মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে যে, এ হামলাগুলো খুবই বিশৃঙ্খলভাবে করা হচ্ছে; যা যুদ্ধপরাধের শামিল।

নাগরিক রক্ষায় যুদ্ধনীতি মানার পরামর্শ : হামাসের হামলার একেবারে প্রথম দিন থেকে ইসরায়েল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সেটিতে সমর্থন দিয়েছেন। তবে তিনি এটাও যুক্ত করেন, সঠিক পন্থায় এটি করতে হবে। যার মানে তিনি বুঝিয়েছেন, ইসরায়েলকে বেসামরিক নাগরিক রক্ষায় যুদ্ধের নীতি মেনে চলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তেল আবিবে গেছেন। সেখানে যাওয়ার আগে তিনি বলেন, আমি যখন একটা ফিলিস্তিনি শিশু ছেলে বা মেয়েকে দেখি যে, ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বের করা হচ্ছে, সেটা আমাকে ততটাই আঘাত করে, যতটা আমি ইসরায়েলি বা অন্য যে কোনো শিশুদের বেলায় অনুভব করি। তাই ব্লিঙ্কেনের সফর ইঙ্গিত দেয়, তার বিশ্বাস, ইসরায়েলিরা বাইডেনের পরামর্শ মানছে না। তবে এর বাস্তবতা জানা নেই কারোর।

যুদ্ধে নেতানিয়াহুর জড়ানো অনুচিত : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভীষণ চাপে আছেন। যদিও তিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর প্রধানদের মতো গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল সীমান্তে যে মারাত্মক নিরাপত্তা বিপর্যয় ঘটেছে, এর কোনো ব্যক্তিগত দায়ভার স্বীকার করেননি। গত ২৯ অক্টোবর তার একটা টুইট আলোচনার ঝড় তোলে। যেখানে তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করেন। তবে পরে মি. নেতানিয়াহু টুইটটি মুছে দেন ও ক্ষমা চান। তিনজন ইসরায়েলি, যাদের একজন সাবেক শান্তি মধ্যস্থতাকারী, আরেকজন শিন বেতের (ইসরায়েলের ঘরোয়া নিরাপত্তা সংস্থা) সাবেক প্রধান এবং একজন প্রযুক্তি ব্যবসায়ী; তারা ফরেন অ্যাফেয়ার্সে জার্নালে একটা নিবন্ধ লেখেন। যেখানে তারা বলেন, এ যুদ্ধ ও আগামীর দিনগুলোতে মি. নেতানিয়াহুর কোনোভাবেই জড়িত থাকা উচিত হবে না।

প্রাচীন পদ্ধতি বিভাজন ও শাসন : ২০০৫ সালের দিকে শেষ ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সমাপ্তির পরে একটা কাঠামো তৈরি হয়; যেটা মি. নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য টিকিয়ে রাখা যাবে। যুক্তি ছিল, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের জন্য আর হুমকি নয়। বরং তারা এমন একটা সমস্যা, যেটার সমাধান আছে। এ জন্য বেছে নেওয়া হয় প্রাচীন পদ্ধতি বিভাজন ও শাসন এবং একই সঙ্গে প্রয়োজনে কঠোর ও নমনীয়। মি. নেতানিয়াহু যিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সালে একবার ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০০৯ সালের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায়; তিনি সব সময় বলে এসেছেন, শান্তির জন্য ইসরায়েলের কোনো অংশীদার নেই। কিন্তু সম্ভবত ছিল। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ), যারা হামাসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী; এর অনেক সমর্থকই মনে করেন, তাদের বয়স হয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের এখন সরে দাঁড়ানো উচিত। তবে তারা ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাটা ১৯৯০-এর দশকে গ্রহণ করে। বিভাজন ও শাসন নীতির মাধ্যমে মি. নেতানিয়াহু পিএ’র জায়গায় হামাসকে গাজায় শক্তি বৃদ্ধি করতে দিয়েছেন।

রক্তপাত হতে যাচ্ছে আরো : যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে থাকা ইসরায়েল এমন কোনো চুক্তিতে যাবে না, যা হামাসকে ক্ষমতায় রাখবে। অর্থাৎ আরো বেশি রক্তপাত হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এ প্রশ্নও উঠছে, তাহলে কে বা কারা তাদের জায়গায় আসবে? সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আরব আর ইহুদিদের মধ্যে জর্দান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মাঝের জমি নিয়ে বিরোধ ১০০ বছরের বেশি টিকেছিল। এ দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাস বলে দেয়, সামরিক পথে কোনো সমাধান আসবে না। নব্বইয়ের দশকে ইসরায়েলের পাশাপাশি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ সংকট সমাধানের চেষ্টায় অসলো শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল; যা বাস্তবায়নে সর্বশেষ চেষ্টা দেখা গেল ওবামা প্রশাসনের সময়। বছরের পর বছর বৈঠক-আলোচনা চলল। কিন্তু এক দশক আগেই সেটা ব্যর্থ হয়েছে, আর তারপর থেকে এ সংঘাত ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র না হলে প্রজন্মতর যুদ্ধের শঙ্কা : প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন, আরো বেশি যুদ্ধ এড়ানোর একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হলো, ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু উভয় দিকে এখন যে নেতৃত্ব আছে, তাদের দ্বারা এটা সম্ভব নয়। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দিকের চরমপন্থিরা এ ধারণা ঠেকাতে যা করার করবেন। যেমনটা তারা ১৯৯০-এর পর থেকে করে আসছেন। কিন্তু এ যুদ্ধ যদি এখন তাদের চিন্তা-ভাবনায় ধাক্কা না দেয় এবং দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আরো অবশ্যম্ভাবী করে না তোলে, তাহলে আর কিছুতেই সেটা সম্ভব হবে না। আর দুই পক্ষের বোঝাপড়ার মাধ্যমে এ সংঘাতের অবসান না হলে, দুই দিকের আরো অনেক প্রজন্ম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত