এবারের জাতিসংঘ সম্মেলন যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ (মঙ্গলবার) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। জাতিসংঘের ৭৯তম এ অধিবেশনে তার ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। ড. ইউনূস এমন সময় জাতিসংঘের এ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন, যার মাত্র দেড় মাস আগে বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসন ক্ষমতাকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে এখন দেশটিতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করছে। ফলে এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে হচ্ছে। এবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য কেন বা কতটা গুরুত্ব বহন করছে?
বাংলাদেশের জন্য এবারের সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ : বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছে। এর আগে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের একপ্রকার টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করে আসছিল। ফলে এ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রেক্ষাপট হিসেবে বিশ্লেষকদের অনেকে দেখছেন। এমন মনোভাব পরিষ্কার হয়েছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যেও। এবারের অধিবেশন দেশের জন্য ‘বিশ্বসভায় নতুন পদচারণা’ এবং বিশ্ব দরবারে নতুনভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার ‘বিশাল সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন মি. হোসেন। বাংলাদেশে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
এ উপলক্ষে আজ জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বাংলাদেশ একটি উচ্চ পর্যায়ের রিসেপশন আয়োজন করেছে। যেখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান, জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা, কিছু সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এবারের অধিবেশনে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট, এ মুহূর্তে কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন, ভবিষ্যতে তারা কী করতে চান, এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা এবং তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আহ্বান জানানো’ এ বিষয়গুলো দেখা যাবে বলে ধারণা করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ূন কবির। ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেয়া এবং বাংলাদেশের হয়ে কথা বলাটা একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জায়গা, বিভিন্ন সংস্কারের কৌশলগত বা টেকনিক্যাল দিকে সাপোর্ট, বিদেশে টাকা পাচার, অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে চলমান তদন্ত, এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার পথ সুগম হবে বলেও মনে করেন মি. কবির।
আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হাসান মনে করেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগ আনতেও এবারের সম্মেলনটিকে কাজে লাগানো হতে পারে। তিনি বলছেন, ‘আমাদের তো দরকার এখন আর্থিক সহায়তা এবং সহযোগিতা।’ ফলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণে এবং একটা টেকসই আর্থিক উন্নয়নে ড. ইউনূস বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল সাইডলাইনে আলোচনা করবেন বলে মনে করেন তিনি। সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌস মনে করেন, উন্নয়ন, ঋণ বা আর্থিক সহায়তার মতো বিষয়গুলো কমিটি পর্যায়ের আলোচনায় আসবে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল সেখানে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের জন্য এবারের পরিষদ কতদূর ফলপ্রসূ হবে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যু জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অন্যতম উদ্বেগের জায়গা ছিল। সেখানেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কর্মকর্তারা পরিবর্তিত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবেন বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হাসান মনে করেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, মানবাধিকার এমন বিষয়গুলোও তাদের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বসহ আসবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, সেটা তারা তুলে ধরতে চাইবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে শুভেচ্ছা পেয়েছেন। বিশ্বপরিসরে খ্যাতির কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন।
সাবেক কূটনীতিবিদ নাসিম ফেরদৌস মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং একরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জায়গা থাকায় তার বক্তব্য একটা বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে। অর্থনীতির বাইরে প্রযুক্তিগত দিক, তরুণ প্রজন্মের অংশিদারিত্ব, রাজনৈতিক সহযোগিতা, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সদিচ্ছার মতো দিক নিয়ে আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের যেসব অগ্রাধিকারের যেসব জায়গা রয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, তাদের প্রতিনিধিদল সেসব ইস্যু সংক্রান্ত ইভেন্টে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে। এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে বলে আশাবাদও জানিয়েছেন তিনি। ২৭ তারিখ বক্তব্যে যে বিষয়গুলো উঠে আসবে, তার একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ, জনগণকেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু ইস্যু, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর, ফিলিস্তিন- এমন বিভিন্ন বিষয় আসতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
ভারত প্রসঙ্গ : এমন অধিবেশনে সভার বাইরে নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক একটা বড় গুরুত্ব বহন করে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশি ভারত বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বের জায়গা। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নিউইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেখা হচ্ছে না বলে এর মধ্যেই জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে সময় মিলছে বলে জানানো হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ‘যে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে’ সেটা স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে বলে জানানো হয়েছে। সমস্যার সমাধান করতে হলে সমস্যার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে চলবে না। টানাপড়েন দূর করার চেষ্টা করা হবে। একটা ওয়ার্কিং রিলেশন (কাজের সম্পর্ক) রাখার চেষ্টা করা হবে বলে জানান মি. হোসেন। তবে সম্পর্কটা মর্যাদা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে হতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রতিবেশী যেহেতু পরিবর্তন হয় না, অনেক দ্বিপাক্ষিক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা হতেই হবে। ভারতেরও কোনো অপশন নেই, আমাদেরও কোনো অপশন নেই। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং বেশ অনেক জায়গায় দু’দিকের স্বার্থের বিষয় রয়েছে, যেসব কারণেই ভারতের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্কের জায়গা ধরে রাখতে আলাপ-আলোচনা করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষক হুমায়ূন কবির।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ : ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছিল। জাতিসংঘের প্রধান নীতিনির্ধারণী অংশ এ পরিষদ। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সারা বিশ্বের জাতিসংঘের সদস্য সব দেশের নেতারা বৈঠকে বসেন এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশগুলোর মাঝে ভোটাভুটিও হয়। যেমন- এবারের অধিবেশনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য না হয়েও এবারে অধিবেশনে অংশ নিয়েছে ফিলিস্তিন মিশন। এ বছর মে মাসে সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সদস্য করতে পক্ষে ভোট দিয়েছিল ১৪৩টি দেশ। এবারের অধিবেশনে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যুদ্ধ এবং দখলদারিত্ব বন্ধ নিয়েও ভোট হয়েছে। সেখানে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১২৪টি দেশ পক্ষে, ১৪টি বিপক্ষে ভোট দিয়েছে; ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ৪৩টি দেশ।
এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মধ্য দিয়ে আগামী এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বেআইনি দখলদারিত্ব বন্ধে প্রস্তাব পাস হয়েছে। পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে বিশ্বের সার্বিক উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য। এমন উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হয় বার্ষিক অধিবেশন। এবারের অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে ১০ সেপ্টেম্বরে। এ অধিবেশনে সংঘাত নিরসন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করাসহ ভবিষ্যৎকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সংস্থাটির একমাত্র শাখা, যেখানে ১৯৩টি সদস্য দেশের সবাই প্রতিনিধিত্ব করার এবং সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ পায়। সভার বাইরে নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক সাধারণত বেশি গুরুত্ব বহন করে।