চীন ভূখণ্ডে মুসলিম অভিযান
আবদুল্লাহ সাঈদ
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব পৃথিবী চীনে প্রবেশের পথে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি সুউচ্চ পর্বতমালা অবস্থিত। প্রায় ৭ হাজার মিটার উঁচু পৃথিবীর উচ্চতম মালভূমি পামির এবং তিয়েনশান পর্বতমালা এখানে সগৌরবে দণ্ডায়মান। পামির মালভূমি থেকে তিয়েনশানের ঢাল বেয়ে বরফ ঢাকা পথে অনেকটা এগিয়ে গেলে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড়-উপত্যকা। তারপর সামনে সবুজ বনানী। দীর্ঘ পথের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিয়েনশানের গোড়ায় পৌঁছার পর পাহাড় থেকে নামতে নামতেই লেগে যায় অনেকটা সময়। পামির থেকে কাশগর পর্যন্ত গোটা পথ তারিম নদীকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। তারিম অতিক্রমকালে মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রায় অর্ধশত ফুট ওপর থেকে তারিম এখানে একটা সবুজ উপত্যকায় আছড়ে পড়ছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট তারিমের রুপালি রূপ পথিকের মন কেড়ে নেয়। তারিমের পথ ধরে চলতে চলতেই দেখা মেলে আঙুর ও নানান ফলের বাগান ঘেরা এক নগরীর। বর্তমান চীনের প্রবেশদ্বার কাশগড় শহরের শুরু এখান থেকেই।
ইসলামের দাওয়াতে কুতাইবা বিন মুসলিম : দুর্লঙ্ঘনীয় সব প্রাকৃতিক বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়ে মুসলিম সেনাপতি কুতাইবা বিন মুসলিম এ পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন চীন জয় করতে। জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বের করে চীনকেও ইসলামের শাশ্বত আলোর শামিয়ানা তলে নিয়ে আসতে। কুতাইবা বিন মুসলিম প্রথম সারির একজন ইতিহাসবরেণ্য সেনানায়ক। যে বিশাল ভূমিকে তিনি ইসলামে সালতানাতের পতাকাতলে নিয়ে এসেছেন। তার ব্যপ্তি ছিল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও ইতালির সামষ্টিক আয়তনের সমান। এসব অঞ্চল বিজয়ে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এমন জাতির সঙ্গে, যারা যুদ্ধ চর্চায় অসাধারণ পটু, রণকৌশলী, বীর লড়াকু এবং যুদ্ধবাজ জাতি। ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের শাসনকাল (৭০৫-১৫ হি.)। মুসলিম বিজয়ের তখন স্বর্ণযুগ। ওয়ালিদ তার সময়ে একসঙ্গে চারটা সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন উত্তরে কনস্টান্টিনোপল, দক্ষিণে ভারতীয় উপমহাদেশ, পূর্বে মধ্যএশিয়া এবং পশ্চিমে আন্দালুস বিজয়ের লক্ষে। কুতাইবা দায়িত্ব পান মধ্যএশিয়ায়।
কুতাইবা বিন মুসলিমের পরিচয় : গৌণ মর্যাদার আরব গোত্র বাহেলি বংশে কুতাইবা জন্মগ্রহণ করেন। যে বংশীয়রা বংশপরিচয় বলতে লজ্জাবোধ করত। ওয়ালিদের গভর্নর হাজ্জাজ যখন একাধিক রণাঙ্গনে লড়াইকারী প্রাপ্তবয়স্ক অভিজ্ঞ সেনাপতিদের রেখে তরুণ কুতাইবাকে মধ্যএশীয় বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্ত করেন, তখন হাজ্জাজের ভয়ে তা প্রত্যাখ্যান না করলেও মনে মনে তাকে মেনে নিতে পারছিল না অনেকেই। কিন্তু অল্প ক’দিন না যেতেই প্রমাণিত হয়, রণাঙ্গনের নেতৃত্বে কুতাইবা কতটা পারদর্শী। আর উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনে, ব্যক্তির মাঝে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে হাজ্জাজ কতটা সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ও গভীর দূরদর্শিতার অধিকারী। ৭০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বীর সেনানী কুতাইবা বিন মুসলিম বাহেলির নেতৃত্বে মধ্যএশিয়ায় ইসলামি বিজয়াভিযান পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। মধ্যএশিয়ার বোখারা, সমরকন্দ, শাশ, ফারগানা ইত্যাদি বিরাট বিরাট ভূখণ্ডে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কিস্তানের পুরো পশ্চিমাংশ বিজয় করেন। তুর্কিস্তানের শেষ প্রান্ত চীন সীমান্তবর্তী পূর্ব অংশে পৌঁছে যান ৭১৫ সালের মধ্যেই। এবার পূর্ব তুর্কিস্তানকেও ইসলামি খেলাফতের অধিভুক্ত করতে হবে।
তুর্কিস্তান বিজয়ের গল্প : এমনিতে কাশগড় জয় একটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করছিল মুসলমানদের জন্য। চীনা সীমান্তে বা চীনা রাজার ওপর চাপ তৈরি করা বা চীন বিজয়ের একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে কাশগড় বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া কাশগড়ের অবস্থানের বিচিত্রতার কারণে সেখান থেকে বহির্বিশ্বে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য এ শহর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, বাণিজ্যের মাধ্যমেই অন্যান্য দেশে মুসলমানদের ইসলাম প্রচারের পথ সাবলীল ও সুগম হবে। কাশগড়ের এ ঐতিহাসিক অবস্থানের ফলেই মুসলমানদের জন্য তা জয় করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। চীনা রাজাদের প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এবং বারবার সেনা অভিযান পরিচালনা করেও তারা দুর্ভেদ্য নগরী কাশগড়কে প্রাচীন চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। তাই কাশগড় বা পূর্ব তুর্কিস্তানের মূল ভূখণ্ড বিজয় মুসলমানদের জন্য সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না। মধ্য এশিয়ার মাটিতে ক’দিন পরপর বিদ্রোহ উস্কে দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল চীনের। এজন্য চীন সম্রাটের শির নত না করার আগপর্যন্ত মধ্য এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সেই প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখেই কুতাইবা দু’বছর রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করার পর ৭১৫ সালে (৯৬ হি.) চীন অভিমুখে অগ্রসর হন। অজেয় পূর্ব তুর্কিস্তানিদের সঙ্গে প্রবল লড়াইয়ের পর অবশেষে তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এভাবেই চীনের সীমান্ত শহর তৎকালীন পূর্ব তুর্কিস্তানের রাজধানী কাশগড় জয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব-তুর্কিস্তান পূর্ণভাবে মুসলমানদের অধিকারে আসে। পুরো তুর্কিস্তান বিজয় সম্পন্ন হয়।
আলোচনার মাধ্যমে রাজ্য বাঁচানোর কৌশল : এবার চীনে অভিযান পরিচালনার আগে ইসলামের শাশ্বত রীতি অনুযায়ী দূতের মাধ্যমে চীন সম্রাটের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন। তাকে ইসলাম গ্রহণ বা জিজিয়া কর প্রদানের আহ্বান জানান। এমনিতেই চীন সম্রাট মধ্য এশিয়ার এতদিনের করদাতা রাজ্যগুলোকে ইসলামের পতাকাতলে চলে যেতে দেখে মনে মনে বিক্ষুব্ধ ছিল। যদি মুসলিম বাহিনী চীনে চলে আসার সংবাদ না পেত, তাহলে অল্প ক’দিনের মধ্যেই পুনরায় মধ্য এশিয়া জয় করে নেয়ার কার্যক্রম শুরু করে দিত। কিন্তু তাদের এগিয়ে আসতে দেখে সে কিছুটা ভড়কে গেল। মোটাদাগে চীনও তখন নিজেদের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে সামরিকভাবে সরাসরি তাদের মোকাবেলায় যাওয়ার সাহস করেনি। তাছাড়া মুসলিম বাহিনীর ব্যাপারে তারা যা শুনে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে, তা তাদেরকে ভড়কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। চীনের এ সীমান্তে এসে দাঁড়ানোর আগে তারা পারস্যের মতো বিশাল দুর্দমনীয় শক্তিকে নেস্তানাবুদ করে এসেছে। ধ্বংস করে দিয়েছে রোমানদের আধিপত্য; এমনকি ইউরোপের ফ্রান্স পর্যন্ত তাদের বিজয়বাহিনীর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। ফলে চীন সম্রাট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজের রাজ্যকে বাঁচিয়ে নেয়াটাই কল্যাণকর মনে করল।
চীন সম্রাটের দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ : সে আলোচনার জন্য কুতাইবার কাছ থেকে কূটনৈতিক দল পাঠানোর আবেদন জানায়। কুতাইবার কাছে পত্র লিখে বলে, ‘আমার কাছে আপনাদের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন; যেন আপনাদের উদ্দেশ্য ও আপনাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারি।’ কুতাইবা তখন হুবাইরা ইবনুল মুশামরাজ কিলাবি ও কয়েকজন সুবক্তাসহ দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন সম্রাটের দরবারে প্রেরণ করেন। হুবাইরা উপস্থিত হলেন সম্রাটের রাজধানীতে। ইবনে কাসির লিখেছেন, এটি ছিল অত্যন্ত মনোরম একটি শহর। শহরের ফটক ছিল ৯৯টি। প্রথমদিন সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতকালে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পরেছিল সাদা পোশাক। ভেতরে ছিল পাতলা গাউন। শরীরে মেখেছিল সুগন্ধি। পায়ে ছিল জুতা। পরদিন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সম্রাটের সামনে এলো নকশা করা পোশাক পরে। তাদের মাথায় ছিল পাগড়ি। তৃতীয়দিন তারা পরলেন সাদা পোশাক। মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। হাতে বর্শা ও তরবারি। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনদিন তোমরা তিন রকমের পোশাক পরলে কেন?’ হুবাইরা বললেন, ‘প্রথম দিন যে পোশাক পরেছি, তা পরে আমরা আমাদের পরিবারের কাছে যাই। দ্বিতীয় দিন যা পরেছি, তা পরে আমরা আমাদের আমিরের সামনে যাই। আর আজ যা পরেছি, তা পরে আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হই।’
চীন সম্রাটের ভীতি প্রদর্শন ও মুসলিম প্রতিনিধির জবাব : আলোচনায় সম্রাটের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল, যে কোনো উপায়ে ভীতি সঞ্চার করে মুসলিমদের ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি বললেন, ‘তোমাদের তো জ্ঞানীই মনে হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি, তোমাদের সৈন্যসংখ্যা অনেক কম। তোমাদের সর্দারকে বলে দাও, আমার রাজ্য থেকে চলে যেতে। যদি তোমরা ফিরে না যাও, তাহলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে এমন বিশাল বাহিনী প্রেরণ করব, যারা তোমাদের নামণ্ডনিশানা মুছে দেবে।’ হুবাইরা জবাবে বললেন, ‘আপনি কীভাবে সেই সৈন্যদলকে অল্প বলতে পারেন, যার একপ্রান্ত আপনার চীনসীমান্তে, আর অন্যপ্রান্ত সেই সুদূর জাইতুন ভূমিতে (খেলাফতকেন্দ্র দামেস্কে)। আর আমাদের নিহত ও নিঃশেষ হওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন?! আমরা তো বিশ্বাস করি, আমাদের প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট সময় দেয়া আছে। আর মৃত্যু যখন অনিবার্য, সুতরাং লড়াই করে শহিদ হওয়াই আমাদের কাছে সবচেয়ে মর্যাদার। আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না।’ হুবাইরার জবাব শুনে চীন সম্রাট ঘাবড়ে গেল। বলল, ‘কী করলে তোমাদের সেনাপতি ফিরে যাবেন?’ হুবাইরা বললেন, ‘তিনি শপথ করেছিলেন, হয় আপনারা ইসলাম গ্রহণ করবেন অথবা জিজিয়া দেবেন। এরপর তিনি আপনাদের মাটি মাড়াবেন এবং শাহজাদাদের নিজের আয়ত্তে নেবেন।’ সম্রাট বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তার শপথ পূরণ করব।’
শর্ত মেনে নেয়া এবং সম্রাটের অঙ্গীকার পূরণ : এরপর সম্রাট কয়েকটি স্বর্ণের পাত্রে কিছু মাটি, জিজিয়া হিসেবে প্রচুর নগদ অর্থ আর চারজন শাহজাদাকে কুতাইবার কাছে পাঠালেন। কথামতো চীন সম্রাট এ সবকিছু প্রেরণ করলে কুতাইবা তা গ্রহণ করে নেন। কারণ, দূত কাফেলা সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসতে আসতে তার কাছে খলিফা ওয়ালিদ এবং গভর্নর হাজ্জাজের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছে। এ কারণে তার যুদ্ধ স্পৃহায় ভাটা পড়ে। চিন্তিত কুতাইবা তাই মার্ভে ফিরে যান। মানুষ সব সময় শক্তিমানের অনুসরণ করে। বিরোধী শক্তির দর্প চূর্ণ করে ইসলাম যখন শক্তির আসনে অধিষ্ঠিত হয়, তখন সর্বস্তরের সবার জন্য ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করার পূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। তুর্কিস্তান বিজয় এবং মধ্য এশিয়ার বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া থেকে চীনকে অবদমিত করার মধ্য দিয়ে তুর্কিদের জন্য সেই সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। তারা দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকে। একের পর এক সুবিশাল বিজয় গোটা মুসলিম জাহানের কাছে কুতাইবা বিন মুসলিমকে মহাবিজয়ী সমরবিদরূপে পরিচিত করে তোলে। মুসলিম জাহানের সীমানা চীনের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক