ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে কোনো বিষয় অপূর্ণ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম। দ্বীন হিসেবে তোমাদের জন্য ইসলামকে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা : ৩)। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি একমাত্র ইসলামের মাঝেই। এ দ্বীনই শুধু আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯)। তাই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতাদর্শ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ থেকে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৫)। ইসলাম ধর্মের মূল দর্শন হলো, একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক না করা। শুধু আল্লাহরই ইবাদত করা। আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য ইবাদত না করা। এমনকি কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে না করা।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। একাধিক ইলাহকে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘যদি আসমান-জমিনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ থাকত, তবে উভয়ে ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং তারা যা বলে, আরশের মালিক আল্লাহতায়ালা তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র।’ (সুরা আম্বিয়া : ২২)। এ আয়াত থেকে বোঝা গেল, ইসলামে বহুত্ববাদ ও শিরিকের স্থান নেই। বিপরীত অন্য সব ধর্মের বুনিয়াদ হলো, বহুত্ববাদ ও শিরকের ওপর। সুতরাং এ জায়গায় ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট। আর প্রত্যেক ধর্মের উৎসব ওই ধর্মকে ঘিরেই হয়ে থাকে। ধর্ম থেকে উৎসব আলাদা নয়। উৎসব ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা বলে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার; তারা মূলত সত্য গোপন করে বা সুবিধাবাদী।
অমুসলিমদের অনুষ্ঠানে মুসলিমদের শরিক হওয়া : মুসলমানরা অমুসলিমদের উৎসবে যেতে পারবে কিনা? যেমন- হিন্দুদের পূজামণ্ডপ দেখার জন্য যাওয়া। এর উত্তর হলো, পূজায় সরাসরি আল্লাহতায়ালার সঙ্গে শিরক করা হয়। আর যেখানে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা হয়, সেখানে কোনো মুসলমান যেতে পারে না। এটা যেমন বিবেক পরিপন্থি একটা বিষয়, তেমনি ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। প্রতিমার প্রতি সন্তুষ্ট চিত্তে সম্মান প্রদর্শনের জন্য বা পূজা করার জন্য তাদের উৎসবে অংশগ্রহণ করলে রেজা বিল কুফুরের কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। আর এমনিতেই দেখার জন্য অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ করা হারাম। তাওহিদে বিশ্বাসী কোনো মুসলিমের জন্য পূজামণ্ডপে যাওয়া কোনোভাবেই বৈধ নয়। কোনো মুসলিম যদি অজ্ঞাতসারে পূজামণ্ডপে যায়, তাহলেও তাকে সুস্পষ্ট তওবা করতে হবে। কেননা, এটি ভয়াবহ পাপ। এজন্য ওমর (রা.) বলতেন, ‘তোমরা মুশরিকদের উপাসনালয়ে তাদের পূজার সময় প্রবেশ করো না। কেননা, এ সময় তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হয়।’ (আস সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি : ১৮৮৬১)। তিনি আরো বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাক।’ (আস সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি : ১৮৮৯২)। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিধর্মীদের সমাবেশ ও পাপ কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করল, অবশ্যই তাদের সঙ্গে তাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে।’ (উমদাতুল কারি : ১১/২৩৭)। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পাপিষ্ঠদের প্রতি ঝুঁকবে না; নতুবা তোমাদেরও জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো বন্ধু লাভ হবে না। তখন তোমাদের কেউ সাহায্যও করবে না।’ (সুরা হুদ : ১১৩)। প্রখ্যাত ইমাম আবু হাফস আল কাবির (রহ.) বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ৫০ বছর আল্লাহর ইবাদত করে, অতঃপর সে যদি মুশরিকদের উৎসবের সময় সেদিনকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কোনো মুশরিককে অথবা তাদের উৎসবে কিছু উপহার বা অর্থ দেয়, তবে সে কুফুরি করেছে এবং নিজের সমস্ত আমল ধ্বংস করেছে।’ (রদ্দুল মুহতার : ৬/৭৪৫)।
বিধর্মীদের উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো : বিধর্মীয় উৎসবের প্রতি সন্তুষ্ট চিত্তে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক শুভেচ্ছা জানালে তা স্পষ্ট শিরক বলে গণ্য হবে। আর এমনিতেই তাদের উৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানালে তা হারাম হবে। এটি সর্বসম্মতিক্রমে হারাম; এতে কারো ভিন্ন মত নেই। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘কোনো কুফুরি আচার-অনুষ্ঠান উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।’ যেমন- তাদের উৎসব ও উপবাস পালন উপলক্ষে বলা, তোমাদের উৎসব শুভ হোক। কিংবা তোমার উৎসব উপভোগ্য হোক। কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনো কথা বলা। যদিও এ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা কুফুরির পর্যায়ে না পৌঁছে, তবু এটি হারাম। এটি ক্রুশের সেজদা করার জন্য কোনো ব্যক্তিকে অভিনন্দন জানানোর সমতুল্য গোনাহ। বরং আল্লাহতায়ালার কাছে মদ পান করা, আত্মহত্যা করা, ব্যভিচার করার কারণে কাউকে অভিনন্দন জানানোর চেয়েও বেশি ঘৃণ্য। (আহকামু আহলিজ জিম্মাহ : ১/৪৪১)।
প্রসাদ খাওয়া : প্রতিমার জন্য উৎসর্গ করা খাবার খাওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া যে প্রাণী গাইরুল্লাহর জন্য জবাই করা হয়, অনুরূপভাবে যে প্রাণী বলি দেওয়া হয় বা বেদিতে উৎসর্গ করা হয়, ওইসব প্রাণীর গোশত মুসলমানের জন্য খাওয়া কোনোভাবেই বৈধ নয়; বরং তা স্পষ্ট হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গিত।’ সুতরাং একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে। এতে ইসলামে কোনো বাঁধা নেই। মুসলিমরা অমুসলিমদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাঁধা দেবে না। তাদের নিশানা ভাঙবে না। পাশাপাশি তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যাবেও না, দেখবেও না। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম ও খতিব, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, ময়মনসিংহ