ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতন

নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট আজ বিশ্ব মুসলিম। পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত তারা। জোটবদ্ধ কুফরি শক্তি ইসলাম ও মুসলিম নিধনের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে ইসলাম নামের বৃক্ষটি তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে জীবন্ত থাকাকে আদৌ তারা মেনে নিতে পারছে না। এ হীন স্বার্থ হাসিলের লক্ষে তারা এঁকে চলছে কুটিল ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা। ফলে কয়েক শতক ধরে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিষ্পেষণ চলছে। সাম্প্রতিকালে এসব আরও বেড়েছে। মিয়ানমারে মুসলিম নিধন চলছে বহুদিন যাবত। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ মুসলমান বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এসব বর্বরতা এখনও চলছে। শ্রীলংকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মুসলমানের জানমালের ক্ষতি হয়েছে। চীনেও মুসলিমরা অবারিত নির্যাতিত হচ্ছে। রাশিয়ার চেচনিয়া ও দাগিস্থানে মুসলিম নির্যাতন চলছে দীর্ঘকাল। আর ফিলিস্তিনিরা তো নিজ আবাসভূমিতেই পরবাসী হয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায়ও ইসলামবিদ্বেষ চলছে বহুদিন ধরে।

চীনে উইঘুর মুসলিম নির্যাতন : চীন একটি কমিউনিস্ট দেশ। সিনহুয়া (সরকারি বার্তা সংস্থা) ও সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদই চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একমাত্র জানার উপায়। ফলে চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের খবর সামান্য বাইরে আসে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা জাতিসংঘে দাখিল করা প্রতিবেদনে চীনে গণহারে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের আটকের তথ্য দিয়েছে। ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে চীনের প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বল প্রয়োগের দাবি করা হয়। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ উইঘুর মুসলিম। এ প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার ওপর এখানে যাওয়ার ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে।

কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাতন : পৃথিবীর কোথাও মাথাপিছু হারে এত অধিক সংখ্যক দখলদার সৈন্য নেই, যা রয়েছে কাশ্মীরে। কাশ্মীরের জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি এবং আয়তন ৮৫, ৮৬৬ বর্গমাইল। অধিকৃত সে কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর সেনা সংখ্যা ৫ লাখ। অর্থাৎ প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ইরাকে যেখানে ৫৪৫ জন এবং আফগানিস্তানে যেখানে ৩১২ জন দখলদার সেনা, কাশ্মীরে সে সংখ্যা হলো ৫ হাজার। হিসেবে দাঁড়ায়, গড়ে প্রতি ১০০০ কাশ্মীরির জন্য রয়েছে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য। প্রতিটি কাশ্মীরি পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি গড়ে ৫ জন ধরা হয়, তবে অর্থ দাঁড়ায়, যে গ্রামে ২০০ ঘর মানুষের বাস, সেখানে অবস্থান নিয়েছে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য। কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর বিশাল অবস্থান আজ থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই। তবে সে সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে ১৯৮৯ সালে। কারণ, তখন থেকেই কাশ্মীরে ভারতপন্থি শেখ আবদুল্লাহ পরিবারের প্রভাব ব্যাপকভাবে লোপ পায়। তীব্রতর হয় স্বাধীনতার দাবি। সে দাবি এখন প্রতিদিন তীব্রতর হচ্ছে। সেই সঙ্গে দিনদিন বাড়ছে সৈন্যসংখ্যা। সম্ভবত সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন এ সৈন্যসংখ্যা ১০ লাখে গিয়ে পৌঁছাবে। অথচ ভারত বিশ্বজুড়ে বলে বেড়ায়, ভারত উদারপন্থি, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক দেশ ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা তো সে দেশের নাগরিকত্ব স্বেচ্ছায় বরণ করে নেবে, আইন মেনে চলবে; কিন্তু তাদের মাথার ওপর এত সৈন্য কেন? কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এর নজির আছে? সমগ্র ভারত শাসনেও এতজন ইংরেজ সৈন্য ছিল না, যা এখন ভারতীয় সৈন্যের লেবাসে রয়েছে কাশ্মীরে। এটিই কি গণতন্ত্রের নমুনা? ভারত এ কথাও বলে বেড়ায়, কাশ্মীরি জনগণ ভারতের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে। তারা ভারতীয় নাগরিকরূপেই থাকতে চায়।

রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন : মিয়ানমার সরকারের কড়াকড়ির কারণে রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দেখা গেছে, শুধু আগুন আর কালো ধোঁয়া। সেই সঙ্গে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড়। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে নিদারুণ মানবিক সংকটের অন্যতম দৃষ্টান্ত। এটি হলো রোহিঙ্গা সংকট। মায়ানমার বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশ। মায়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রধান অংশ রোহিঙ্গা। দাপ্তরিক ও ব্যবসায়িক কাজে ব্রিটিশরা ভারতীয় মুসলমানদের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) বার্মায় নিয়ে আসে। মায়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর অনেক মুসলমান তাদের পূর্ববর্তী পদে বহাল থাকে। অনেকে ব্যবসা এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। রাজা বায়িন্নাউং (১৫৫০-১৫৮৯)-এর আমলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। বৌদ্ধরা মুসলিমদের হত্যা করে। ১৫৫৯ সালে ব্যাগো দখলের পর বৌদ্ধ রাজা হালাল মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করে। ধর্মের নামে প্রাণী হত্যাকে বর্বোরচিত ঘোষণা করে। ঈদুল আজহা পালন নিষিদ্ধ করে। তার প্রজাদের জোরপূর্বক বৌদ্ধধর্মের বাণী শুনতে বাধ্য করে। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। ১৮ শতকে রাজা আলাউঙ্গাপায়া মুসলমানদের জন্য হালাল খাবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাপতি নে উইন ক্ষমতায় গেলে মায়ানমারে মুসলমানদের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। মুসলমানদেরকে সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত করা হয়। সামাজিকভাবে বিভিন্ন সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

ফিলিস্তিনি মুসলিম নির্যাতন : মুসলমানদের প্রথম কেবলার দেশ ফিলিস্তিনে মুসলমানরাই নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিজ দেশেই পরাধীনের মতো জীবন চলছে তাদের। ইসরাইলের ইহুদি শাসক ও সেনাবাহিনী দ্বারা চরম অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হচ্ছে দেশটির মুসলমানরা। ফিলিস্তিনিরা হতভাগ্যই বটে। তারা প্রায় এক শতক ধরে নিজেদের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিদের হাতে মার খাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঝরছে রক্ত। লাশের পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। ফিলিস্তিনিরা আজও মরছে। ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। আরব মুসলমানরা ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে বাসা বাঁধতে থাকে। তাদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ে। সবকিছুর উদ্দেশ্য আরব ভূখণ্ড দখল। ১৯৪০ দশকে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠালগ্নে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাদের বসতভিটা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া গাজায় গত এক দশকের ইসরাইলি অবরোধের কারণে ২০ লাখ লোকের বসতি গাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। অবরোধ তুলে নেয়ার বিক্ষোভে প্রতিনিয়ত ইসরাইলি সেনাদের দ্বারা ফিলিস্তিনিরা নিহত হচ্ছেন।

ইয়েমেনে মুসলিম নির্যাতন : সৌদি জোটের নেতৃত্বে চলছে ইয়েমেনি মুসলিম গণহত্যা। সৌদির ভয়ংকর বিমান হামলায় দেশটিতে হাজারো মানুষের জীবন চলে গেছে। ধ্বংস হচ্ছে শহরের পর শহর। সৌদি আরবকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে বড় ভূমিকা রয়েছে ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’খ্যাত ইসরাইলেরও। সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনি বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ করছে হুথি বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামী একাধিক বিদ্রোহীগোষ্ঠী। তাদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে ইরানসহ একাধিক দেশ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব দেশ ও বিশ্বনেতারা ইয়েমেন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। কিন্তু সেখানে মানবিক বিপর্যয় নিয়ে যেন কারো মাথা ব্যথা নেই। জাতিসংঘ, এমনকি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনও (ওআইসি) রহস্যজনকভাবে নীরব। এ ধরনের সংস্থাগুলো মাঝে মধ্যে দুয়েকটি বিবৃতি ও প্রতিবাদ জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। ইয়েমেন সমস্যার সমাধানে তাদের যেন কোনো আগ্রহ নেই। বিশ্ব শক্তিগুলোর শক্তি প্রদর্শনের আরেকটি ক্ষেত্র পরিণত হয়েছে সিরিয়া।

বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দেশটি। মুসলিমপ্রধান দেশটিতে ২০১১ সাল থেকে চলে আসা গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের দাবি, এ যুদ্ধে তিন লাখ ৬৪ হাজার ৭৯২ থেকে পাঁচ লাখ ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে এ সংখ্যায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তবে এটা সত্য, সিরিয়ায় মৃত্যুর শিকার মানুষের সংখ্যা আঁতকে ওঠার মতো। এর একটি বড় অংশই নারী ও শিশু। এ দুই শ্রেণি সবচেয়ে অসহায় হলেও বিশ্বের ইতিহাসে যুদ্ধগুলোতে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে।

লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত