ইয়াহইয়া সিনওয়ার গাজার দক্ষিণে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেছেন। পরে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের নেতা ৬১ বছর বয়সী ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামলার বড় পরিকল্পনকারী ইয়াহইয়া। ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধের শুরুতেই গা ঢাকা দেন ইয়াহইয়া সিনওয়ার। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১২০০ জন নিহত হয়েছেন। ২৫১ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। তবে ইয়াহইয়া সিনওয়ারের মৃত্যু খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা ড্রোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও গুপ্তচরের মাধ্যমে তার অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-এর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ইয়াহইয়া সিনওয়ার হলেন কমান্ডার এবং তিনি মারা গেছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য : ধারণা করা হতো, সিনওয়ার গত বছর বেশিরভাগ সময় গাজার নিচের সুড়ঙ্গগুলোতে লুকিয়ে ছিলেন। সেখানে তার দেহরক্ষীরা ছিলেন। যাতে তাকে ট্র্যাক করা না যায়, সেজন্য খুব কম মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তা ছাড়া ইসরায়েলি বন্দিদের তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ গাজায় অপারেশন চালিয়ে একটি ভবনের ভেতর ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। আইডিএফ-এর তথ্য মতে, সে সময় সেখানে কোনো ইসরায়েলি বন্দি ছিল না। গত বৃহস্পতিবার তার মৃত্যুর ঘোষণা দেয়ার পর তার লাশ শনাক্ত করতে আঙ্গুলের ছাপ ও দাঁতের রেকর্ড দেখানো হয়। ইয়াহইয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, যিনি আমাদের জনগণের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছেন, হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করেছে, আমাদের শত শত নাগরিককে হত্যা করেছে, তিনি আজ আমাদের বীর সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমরা যেমনটি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তার সঙ্গে সে হিসাব মেটালাম।
উত্থান ও গ্রেপ্তার : ইয়াহইয়া সিনওয়ার আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা-মা আশকেলন থেকে ফিলিস্তিনে এসেছেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনির সঙ্গে তারাও বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তারা সেখানকার শরণার্থীতে পরিণত হন। কারাগারে ইয়াহইয়া সিনওয়ারের চারবার সাক্ষাৎকার নেয়া ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি জানান, খান ইউনিসে মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি বিশাল আস্তানা ছিল। শরণার্থী শিবিরের দরিদ্র যুবকদের মসজিদে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এ ইসলামিক গ্রুপ। পরে স্থানটি হামাসের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে সিনওয়ার প্রথমবার ‘ইসলামিক কার্যকলাপের’ জন্য ইসরায়েলের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯৮৫ সালে তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন। এ সময় তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেন, সিনওয়ার ও ইয়াসিন একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সঙ্গে এ সম্পর্ক পরবর্তী আন্দোলনে সিনওয়ারকে একটি হ্যালো ইফেক্ট দেয়। ১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
কারাগারের বছরগুলো : সিনওয়ার ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল ২২ বছরেরও বেশি সময় ইসরায়েলের কারাগারে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে নির্জন কারাবাসের সময়গুলো তাকে আরও উগ্র করে তুলেছিল বলে মনে করা হয়। ইয়ারি বলেন, তিনি তার শক্তি ব্যবহার করে কোনো দয়া-মায়া ছাড়াই নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বন্দিদের মধ্যে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বন্দিদের পক্ষে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। বন্দিদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। ইসরায়েলি সরকার একটি মূল্যায়নে কারাগারে থাকা সিনওয়ারকে নিষ্ঠুর, কর্তৃত্ববাদী, প্রভাবশালী, অস্বাভাবিক সহনশীল, চালাক ও ম্যানিপুলেশনের অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর ছোটখাটো জিনিসে সন্তুষ্ট থাকাসহ কারাগারের অন্য বন্দিদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় গোপন রাখতেন সিনওয়ার। ইয়ারির মূল্যায়ন অনুসারে, সিনওয়ার একজন চতুর ও বিচক্ষণ লোক। তিনি মুহূর্তের মধ্যে তার ব্যক্তিগত আকর্ষণের ধরণ পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন। ২০১১ সালে এক চুক্তির অংশ হিসেবে সিনওয়ার মুক্তি পান। সে চুক্তি অনুসারে, ইসরায়েলের শুধু এক আইডিএফ-এর সেনা সদস্য গিলাদ শালিতের বিনিময়ে ১০২৭ জন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি আরব বন্দি মুক্তি পায়। শালিত পাঁচ বছর হামাসে বন্দি ছিলেন। হামাসের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের একজন সিনওয়ারের ভাই শালিতকে অপহরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সিনওয়ার আরও অনেক ইসরায়েলি সেনা সদস্যদের অপহরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ততক্ষণে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় তার দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে। হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিপক্ষ ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টির সদস্যদের অনেককে উঁচু ভবন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে।
যত নিয়মকানুন : সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসার পর তাকে তৎক্ষণাৎ একজন নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অনেক বছর ইসরায়েলের কারাগারে থাকায় তিনি এ মর্যাদা পেয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে মাইকেল বলেন, মানুষ তাকে ভয় পেত। কারণ, তিনি নিজ হাতে শত্রুদের হত্যা করেছেন। তিনি ক্যারিশমাটিক ছিলেন। তার বিষয়ে ইয়ারি বলেন, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সিনওয়ার ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেডের সঙ্গে একটি জোট গড়েন। প্রধান স্টাফ মারওয়ান ঈসার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। ২০১৩ সালে তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৭ সালে এর প্রধান হন। সিনওয়ারের ছোট ভাই মুহাম্মদও হামাসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালে হামাস তার মৃত্যুর ঘোষণা দেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি অনেকবার দাবি করেছেন, তিনি কয়েকবার ইসরায়েলের হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এর পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে এমন রিপোর্ট এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, মুহাম্মদ এখনও বেঁচে আছেন, হামাসের সামরিক শাখায় সক্রিয় এবং গাজার সুড়ঙ্গে লুকিয়ে রয়েছেন। এমনকি ৭ অক্টোবরের হামলায়ও তার ভূমিকা থাকতে পারে। ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার শক্ত নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হামাসের সদস্যরা জানত, তার আদেশ অমান্য করলে তাদের জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে।
মুজাহিদ হিসেবে তালিকাভুক্তি : ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে অনেকেই মনে করেন, বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে সিনওয়ারকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া ভয়াবহ ভুল ছিল। ইসরায়েলিরা মনে করে, তারা একটি ভ্রান্ত নিরাপত্তা অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, হামাসকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং আরো কাজের অনুমতি দিলে তাদের আন্দোলনটি যুদ্ধের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়কর ভুল হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার নিজেকে ফিলিস্তিন মুক্ত করার জন্য নিয়তিবদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে দেখতেন। গাজার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা সামাজিক পরিষেবার উন্নতির ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। ২০১৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিনওয়ারকে বিশেষভাবে মনোনীত বৈশ্বিক মুজাহিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি বিমান হামলাগুলো চালানো হয় সিনওয়ারের বাড়ি এবং দপ্তরগুলো লক্ষ্য করে। ২০২২ সালের এপ্রিলে এক টেলিভিশনের ভাষণে জনগণকে যেকোনো উপায়ে ইসরায়েলকে আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। বিশ্লেষকরা সিনওয়ারকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো ও এর সশস্ত্র শাখা ইজ্জাদিন আল কাসসাম ব্রিগেডের মূল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক : সিনওয়ার ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একটি শিয়া দেশের সঙ্গে একটি সুন্নি আরব সংগঠনের সম্পর্ক সুস্পষ্ট নয়। তবে উভয়েরই লক্ষ্য হলো, ইসরায়েল রাষ্ট্রকে শেষ করা এবং জেরুজালেমকে ইসরায়েলি দখল থেকে মুক্ত করা। তারা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। ইরান হামাসকে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এভাবে হামাসের সামরিক সক্ষমতা তৈরি এবং হাজার হাজার রকেটের একটি অস্ত্রাগার তৈরিতে সাহায্য করে ইরান। ২০২১ সালে সিনওয়ার একটি ভাষণে ইরানের এ সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ইরান যদি না থাকত, ইসরায়েলকে প্রতিরোধে ফিলিস্তিনের এ সক্ষমতা থাকত না।
হামাসের জন্য বড় ধাক্কা : ইয়াহইয়া সিনওয়ারের মৃত্যু হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা। আগস্টে হানিয়ার মৃত্যুতে হামাস যখন সিনওয়ারকে গোষ্ঠীর প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে, তখনই এটি তাদের জোরালো প্রতিবাদ ও স্থিতিশীলতার সচেতন পদক্ষেপ ছিল। তার চেয়ে আরো আপোসহীন ব্যক্তিত্ব গোষ্ঠীতে আর কেউ ছিল না। গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েল সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে চুক্তি করতে চায় কি না, সিদ্ধান্ত এখন হামাসের হাতে কিংবা এর বিপরীতও হতে পারে। তারা এ যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারে। যদিও এ সংঘাত এরই মধ্যে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন সম্প্রতি বলেছেন, গাজার মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সিনওয়ারের মৃত্যু সেই চুক্তি সম্পন্ন করার এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হতে পারে। তবে এর বিপরীতও ঘটতে পারে। কারণ, ক্ষুব্ধ হামাস সদস্যরা যে কোনো ধরনের আপস থেকে নিজেদের আরও দূরে রাখতে পারে।