র্যাডক্লিফের কলমের খোঁচায় দেশভাগ
অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাম্রাজ্যবাদের প্রধান পুরোহিত ব্রিটেন ভারত উপমহাদেশে ২০০ বছরের শাসন-শোষণের পর বিদায়বেলায় এমন সব সমস্যা জিইয়ে রেখে গেছে, যার মাশুল আজও উপমহাদেশবাসীকে দিতে হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ভারতবর্ষের বুকে লাখো মানুষের রক্তে আকা দাগ ‘র্যাডক্লিফ লাইন’। ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হলেও দলটিতে হিন্দুদের স্বার্থই বেশি করে রক্ষিত হতে থাকে। ফলে ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন থেকে মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের যাত্রা হয়। এখান থেকেই মূলত ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিন্দু-মুসলিমদের বিভাজনের সূচনা। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে এ বিরোধ আরো চরমে ওঠে। সর্বশেষ ১৯৪০ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করলে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন সামনে চলে আসে। মুসলিম লীগ প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ম্যান্ডেট লাভ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রদীপ যখন নিভু নিভু জ্বলছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তখন বাসা বেঁধে বসে গোটা ভারতে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হতে থাকে। এ সময় ব্রিটিশরা দ্রুত ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা নামে একটি আইন পাস করে। ভারত বিভক্তির জন্য একই বছর (১৯৪৭) লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করে ভারতে পাঠানো হয়। মাউন্টব্যাটেন দ্বারস্থ হলেন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে। জওহরলাল নেহেরু দেশভাগ নিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনা করলেন। মাহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস শুরু থেকেই অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে অটল ছিল।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ দ্বি-জাতি তত্ত্ব আঁকড়ে ধরে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র (পাকিস্তান) প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে একচুল নড়ার জন্যও প্রস্তুত নয়। ফলে লর্ড মাউন্টব্যাটন সীমান্ত ভাগের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। নামজাদা ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়। যাদের কাজ ছিল ভারতবর্ষকে ভাগ করে দুটি আলাদা রাষ্ট্র- ভারত ও পাকিস্তান গঠন করা। এই ভাগ করার অন্যতম মানদ- হয় ধর্ম। সে অনুযায়ীই ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট একটি সীমানা টেনে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করে ফেলা হয়। কমিশনের প্রধান র্যাডক্লিফের নামে এ সীমারেখার নামকরণ করা হয় ‘র্যাডক্লিফ লাইন’।
ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফের আইন পেশার বাইরে বলার মতো অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। এর আগে তিনি একবার মাত্র ব্রিটিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু তাকেই ভারত ভাগ কমিশনের প্রধান করলেন লর্ড মাউন্টব্যাটন। মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফকে মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় দেন সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাগ করার জন্য। র্যাডক্লিফের সরেজমিন পরিদর্শন তো দূরের কথা, তার কাছে কোনো ভালো মানচিত্র এবং জনসংখ্যার ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছিল না। ফলে তিনি কলমের খোঁচায় হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলকে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে দেন। যেখানে হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমান, সেখানে কি হবে- তার কোনো সমাধান না করেই এসব অঞ্চলকে উভয়ের মধ্যে ভাগ করে দেন। ফলে পূর্বাংশে বাংলা ও পশ্চিম অংশে পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। যার ফলে পাঞ্জাবের একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে (পাঞ্জাব প্রদেশ), আরেকটি অংশ ভারতের সঙ্গে (পাঞ্জাব স্টেট) হিসেবে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে বাংলার পূর্বাংশকে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং পশ্চিম বঙ্গকে ভারতের সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয় শুধু ধর্মের ভিত্তিতে। ধর্মকে সামনে রেখে লাইন টানা শুরু করলে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে, এ বিষয়ের ন্যূনতম কোনো ধারণাও ছিল না র্যাডক্লিফের। ভারতবর্ষের বুকে লাখো মানুষের রক্তে আকা এই র্যাডক্লিফ লাইনের ফলে বলি হয় ১০ লাখ হিন্দু-মুসলমান ও শিখ জনগোষ্ঠী।
মাউন্টব্যাটেনের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে নানা ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট সিরিল র্যাডক্লিফ তার রিপোর্ট তৈরি করেন। তিনি ঘোষণা দেয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তা পিছিয়ে দিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দেয়া হলো, ১৫ আগস্ট ভারতের হাতে। দু’দেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার উল্লাস করছে, তারা তখনও জানত না, কোথায় তাদের সীমান্ত শেষ আর কোথায় তার শুরু। ১৭ আগস্ট প্রকাশিত হলো বহুল প্রত্যাশিত সেই র্যাডক্লিফের সীমান্ত কমিশনের রিপোর্টের গেজেটেড কপি। ভারত ভাগের আসল ভয়াবহতার শুরু সেদিন থেকেই। ধীরে ধীরে সারা ভারতজুড়ে ব্যবচ্ছেদ শুরু হয়ে গেল। নতুন জাতীয় পরিচয় লাভ করল তদানীন্তন উপমহাদেশের ৪০ কোটি মানুষ। জেলা-থানা গড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত যতই সেই সীমান্ত কমিশনের রিপোর্ট যেতে শুরু করল, ততই যেন সাধারণ মানুষের হাহাকার বাড়তে লাগল। সাধের ঘরবাড়ি, সহায় সম্বল, জমি-জমার ওপর দিয়ে যেন র্যাডক্লিফ লাইনের স্টীম রোলার চলে গেল। এতকাল যেসব মানুষ একসঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল, তাদের শুধু কলমের দ্বারা দাগ কাটার সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে ফেলা হলো। জায়গা-জমি ও বসত ভিটা রেখে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীরা পাড়ি জমাতে থাকেন ভারতে আর মুসলমানেরা পাকিস্তানে। বাংলায় তো কারও গৃহস্থের রান্নাঘর চলে গেছে হিন্দুস্তানে, শোয়ার ঘর পড়েছে পাকিস্তানে। বাংলা হচ্ছে নদীর দেশ। প্রায় সব নদী ওপর থেকে নিচে নেমেছে। নদীকে তো কাটা যায় না, তবু কাটা হয়েছে। তাতেই বোঝা গেছে, কেমন অবাস্তব ছিল ঘটনাটি। ভাটি তো শুকিয়ে মরে উজানকে না পেলে; উজান তো প্লাবিত হবে ভাটিতে নামতে না পারলে; দশা হয়েছে সেরকম। ভাটিরই কষ্ট বেশি। কারণ, উজান পানি ছেড়ে দেয় প্লাবনের কালে।
পাঞ্জাব, বাংলা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, কাশ্মিরসহ র্যাডক্লিফ লাইনের আশপাশে চলে রক্তের হোলিখেলা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ দাঙ্গার ট্র্যাজেডি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, আপাত দৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি, এমনটি ঘটবে। পূর্ব পাঞ্জাবে শিখ আর হিন্দুরা মুসলমানদের গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে বাড়িঘর পোড়ার পাশাপাশি নিষ্পাপ, নির্দোষ পুরুষ-নারী ও শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। পশ্চিম পাঞ্জাবে ঠিক একইভাবে মুসলমানরা নির্বিচারে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের পুরুষ-নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাব ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞের কবরখানায় পরিণত হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের হত্যাযজ্ঞের কথা যখন দিল্লি পৌঁছে, সঙ্গে সঙ্গে শহরের মুসলমানদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়।
দিল্লিতে মুসলিম খুনের নেতৃত্ব দেয় শিখরা। শিখদের সঙ্গে যোগ দেয় হিন্দুরাও। সর্দার রাজবল্লভ প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দিল্লি প্রশাসন সরাসরি তার অধীনে। খুন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা এতই বেড়ে গেল, মাহাত্মা গান্ধী প্যাটেলকে তলব করলে প্যাটেল বললেন, তেমন কিছু হয়নি; গান্ধীজির কাছে শুধু অতিরঞ্জিত রিপোর্ট আসছে। এ সময় উপস্থিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্যাটেলের বক্তব্যের বিরোধিতা করে ‘দিল্লিতে পরিস্থিতিটা এমন যে, মুসলমানদের কুকুর-বিড়ালের মতো হত্যা করা হচ্ছে’- দাবি করলে সর্দার প্যাটেল ‘দেখছি এবং ব্যবস্থা নিচ্ছি’ বলে দায়সারা জবাব দেন। উপস্থিত জওহরলাল নেহেরুও দিল্লিতে মুসলিম নিধনের কথা স্বীকার করে সর্দার প্যাটেলকে দিল্লির দাঙ্গারোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক