গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং আড়াইশ জনের মতো অপহৃত হয়েছিল। তারপর থেকে সবার দৃষ্টি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। সবার মনে প্রশ্ন ছিল, ইসরায়েল কতটা তীব্রভাবে এর প্রতিশোধ নেবে; আর এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোর জনগণ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? ইসরায়েলি বোমা বর্ষণে পুরো গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা। এ ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যাযজ্ঞ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেউ যদি আরব বিশ্বের রাজধানীতে গণবিক্ষোভ হবে বলে আশা করে, তবে তারা হতাশ হবে। আরব দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও সংহতির অনুভূতি থাকলেও এসব দেশে বলতে গেলে কোনো বিক্ষোভ হয়নি। কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়ালিদ কাজিয়া বলেন, আরব দেশগুলোর সরকারের প্রতিক্রিয়া খুবই হতাশাজনক এবং না থাকার মতো। ইসরায়েলের প্রথাগত সমালোচনা ছাড়া এবং কাতার ও মিশরের সরকারের পক্ষ থেকে সংঘাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব ছাড়া কেউ ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয়নি। কোনো আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি বা এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে বা যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করবে। কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যু কেন এ অঞ্চলে গুরুত্ব হারাল? মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় এ প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল।
সরকার ও জনমত বিচ্ছিন্ন : এ অঞ্চলের সরকার ও জনমত কখনোই অটুট এবং সমভাবাপন্ন ছিল না। ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, আরবরা একটি পরিচয়, একটি ভাষা এবং বহুলাংশে একটি ধর্মের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। এ অঞ্চলে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক প্রভাবের কারণে আরবের সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। তবে আরবের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর স্বার্থ কখনও কখনও অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক এতটা সহজ ছিল না। বিশেষ করে, তাদের সঙ্গে যারা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পর বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছিল। লেবাননের গৃহযুদ্ধ, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জর্ডানের রাজতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত এ অঞ্চলের সংঘাতের পুরনো ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। তবে ফিলিস্তিন ইস্যুটি কয়েক দশক ধরে আরব দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে ওঠে। দোহা ইন্সটিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক তৈমুর কারমুত বলেন, এ সময়ে ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ঔপনিবেশিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে গেলেও ইসরায়েলকে তার স্বার্থ রক্ষার এজেন্ট হিসেবে রেখে গিয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি নিজেদের জাতীয় স্বার্থও রক্ষা করেছে। যা-ই হোক, সেই যুদ্ধগুলো এখন কেবলই অতীত। মিশর ও জর্ডান কয়েক দশক আগে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছে। মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। অথচ কয়েক বছর আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকে এ অঞ্চলে ন্যক্কারজনক বলে ধরা হতো। ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর আগে সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কাছাকাছি চলে যায়।
আরব বসন্তের মাত্র কয়েক বছর পর যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তিতে পরে মরক্কো ও সুদান যোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া জানাতে বেশি সময় নেয়নি, ওয়াশিংটন পশ্চিম সাহারার ওপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে স্ব-নিয়ন্ত্রণের ওপর গণভোট অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস প্রোগ্রাম ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং এমনকি সৌদি আরবকে দায়ী করা হয়, যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে এর কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, রিয়াদ ২০১৭ সালে প্রোগ্রামটি কিনেছিল। পরের বছর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি বিরোধী সাংবাদিক জামাল খাশোগজিকে হত্যার পর তারা এর ওপর থেকে তাদের অ্যাক্সেস হারায়। আমেরিকান সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করেন। যার কারণে তিনি সফটওয়্যারটিতে নিজেদের অ্যাক্সেস পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
ইসলামি মিলিশিয়াদের উত্থান : ইসলামি চরমপন্থিদের ভয়-জাতীয় স্বার্থ ছাড়াও আরেকটি বিষয় যা আরব দেশগুলোকে ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছিল, তা হলো নিজ নিজ দেশে ইসলামি মিলিশিয়াদের উত্থান। অধ্যাপক ওয়ালিদ কাজিয়ার মতে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর এবং ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বের সময়কালে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রথম তরঙ্গকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখা হতো। তবে এখনকার প্রতিরোধের মূল ভিত্তি হলো ধর্ম। আজ যারা ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করছে, তারা মূলত ইসলামপন্থী। তা হামাস হোক বা হেজবুল্লাহ যে-ই হোক না কেন। তাদের ধারণা ইসলাম থেকে এসেছে, যেমন শাহাদত। ইসলামপন্থি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড আরবের বেশ কয়েকটি সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত। এ কারণে এ সরকারগুলোর অনেকেই হামাসকে হুমকি হিসেবে দেখে। তারা হামাসকে মুসলিম ব্রাদারহুডের শেষ ঘাঁটি হিসেবে দেখে; যা এখনও টিকে আছে এবং হামাস সামরিকভাবে শক্তিশালী। হামাস এখনও ইরানের কাছ থেকে সমর্থন এবং আর্থিক সাহায্য পায়। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি যখন তৈরি হয়, তখন বেশ কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক ছিল, কিন্তু এখন দেশগুলো এ তৎপরতার ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যখন আরব দেশগুলো তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করার জন্য কেউ হামাসকে অস্ত্র দিতে চায়নি, তাই অস্ত্র পাওয়ার জন্য তারা যেকোনো কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে রাজি ছিল। একই কথা হেজবুল্লাহ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যারা ইরানের সমর্থন পাচ্ছে, একইসঙ্গে তারা ফিলিস্তিনিদেরও রক্ষা করতে চায়। যখন ইরান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সামনে চলে এলো, তখন আরব দেশগুলোর বাসিন্দারা আলোচনার মধ্যে আর রইল না। আরবে বেশ কিছু সংগঠন আছে, যারা সত্যি সত্যি ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করতে চায়, এমনকি তাদের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। যেমন হেজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের কিছু শিয়া সংগঠন।’ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিবর্তন ভূ-কৌশলগত স্বার্থ এবং আরব দেশগুলোর সংকট ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলে গেছে। আরব জাতীয়তাবাদের মতো যে ধারণাগুলো একসময় মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা হৃদয়কে ধারণ করত, সেগুলো এখন অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ তরুণ প্রজন্ম ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু তারা সংঘাতের কারণ এবং উৎস জানে না। কারণ, এ বিষয়গুলো আর স্কুলে পড়ানো হয় না। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমাজ এমনকি পরিচয়ও বদলে গেছে। নতুন নেতাদের ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু ঘটছে।