১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশটির প্রায় অর্ধেক ভূমিই ছিল বিভিন্ন মহারাজাদের শাসিত রাজ্যের অন্তর্গত। এ রকম প্রিন্সের সংখ্যা ছিল ৫৬২ জন। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে মিত্রতার বিনিময়ে তারা নিজ নিজ এলাকায় ভোগ করতেন প্রায়-একচ্ছত্র ক্ষমতা। ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল তাদের শাসনাধীন। তবে স্বাধীনতার পর তাদের পক্ষে কেন গণতান্ত্রিক ভারতের কাঠামোর ভেতরে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি, সে এক বিচিত্র কাহিনি। ভারতের মহারাজারা বাস করতেন রূপকথার গল্পের মতো বিলাসবহুল প্রাসাদে। তাদের ছিল অপরিমিত ঐশ্বর্য, হীরা আর মূল্যবান পাথরের সংগ্রহ। ছিল রোলস-রয়েস গাড়ির বহর। তারা ভ্রমণ করতেন বিশেষ ট্রেনে, রাজধানী দিল্লিতে এলে তাদের স্বাগত জানানো হতো তোপধ্বনি দিয়ে। তারা ছিলেন তাদের প্রজাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের প্রতিটি প্রয়োজন মেটাতে ছিল হাজার হাজার ভৃত্য-অনুচর-কর্মচারীর দল।
অনৈক্য ও ভ্রান্ত ধারণার করুণ শিকার : ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশটির প্রায় অর্ধেক ভূমি ছিল এ প্রিন্সদের দখলে। তারা শাসন করতেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারতীয়কে। তারা ছিলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে বিশ্বস্ব মিত্র। প্রায় যে কারোরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। শুধু চরম গুরুতর কোনো অপরাধ করলেই এদের তিরস্কার করা হতো বা অতি বিরল ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পর সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন এরাই। ভারতের স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পর তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে ধনশালী এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন, তারা ছাড়া বাকি সবাই যাপন করছেন সাধারণ জীবন। এ প্রিন্সরা নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য এবং নানা ভ্রান্ত ধারণার করুণ শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, যে শক্তিকে তারা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলেন, তারাই তাদের ডুবিয়েছিল।
মহারাজাদের ভাবনায় ত্রাতা : এ শাসকরা হয়তো তাদের নিজেদের রাজ্য রক্ষা করতে পারতেন এবং স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের ভেতরেই টিকে থাকতে পারতেন, যদি তারা নিজেরা আরও বেশি গণতান্ত্রিক হতেন। কিন্তু ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এসব সংস্কারের জন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকলেও তা খুব জোরালো ছিল না। ফলে এ প্রিন্সরা বাস করছিলেন একটা ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধের মধ্যে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতের শেষ ভাইসরয় হলেন, এ মহারাজারা ভেবেছিলেন, ইনিই হবেন তাদের ত্রাতা। কারণ, মাউন্টব্যাটেন নিজে যেহেতু একজন অভিজাততন্ত্রের লোক, তাই তিনি নিশ্চয় এ প্রিন্সদের জাতীয়তাবাদী নেকড়েদের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না। কিন্তু উপমহাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেনের জানা-বোঝা ছিল খুবই সীমিত।
প্রিন্সদের অস্তিত্ব যিনি মানেননি : এ দেশীয় রাজ্যগুলোর ব্যাপারে কী করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অনেক দেরী করেছিলেন। তা ছাড়া তার দিক থেকে দু’ধরনের বার্তা আসছিল। একদিকে তিনি বলছিলেন, ব্রিটেন এসব দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, তা তিনি কখনোই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না। তাদের ভারত বা পাকিস্তানের কোনোটিতেই যোগ দিতে বাধ্য করবেন না। কিন্তু আবার আরেক দিকে তিনি ইন্ডিয়া অফিসের কর্মকর্তাদের আড়ালে রেখে এ প্রিন্সদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তার সব চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন। ভারতের জাতীয়তাবাদীরা কখনোই এ প্রিন্সদের পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে, জওহরলাল নেহরু; যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি কখনোই এদের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেননি।
ভারতের হৃৎপিণ্ডে ছুরিকাঘাতের শামিল : তিনি এসব দেশীয় রাজ্যকে বর্ণনা করেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতা, অপদার্থতা এবং অপ্রতিহত স্বৈরাচারী ক্ষমতার গহ্বর হিসেবে। যে ক্ষমতার প্রয়োগকারীরা কিছু ক্ষেত্রে ছিলেন হিংস্র ও নিম্নস্তরের ব্যক্তি। এ প্রিন্সদের সঙ্গে চূড়ান্ত দেনদরবার করেছিলেন কংগ্রেস পার্টির নেতা এবং রাজ্যবিষয়ক মন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল। এদের ব্যাপারে তার মনোভাব অবশ্য নেহরুর মতো অতটা খারাপ ছিল না। কিন্তু বল্লভভাই প্যাটেলের এ বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ভারতকে যদি ভৌগলিক এবং রাজনৈতিকভাবে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হতে হয়, তাহলে এসব দেশীয় রাজ্যগুলোকে তার অংশ হতেই হবে। তার কথা ছিল, এ লক্ষ্য থেকে কোনো রকম বিচ্যুতি ঘটলে তা ভারতের হৃৎপিণ্ডে ছুরিকাঘাতের শামিল হবে।
প্রিন্সদের সামনে দুটি বিকল্প : তাত্ত্বিকভাবে প্রিন্সদের সামনে বিকল্প ছিল দুটি। তা হলো, ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়া অথবা ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ব্রিটিশরাজের সঙ্গে তাদের চুক্তি বিলোপের পরপরই স্বাধীনতা ঘোষণা করা। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন, প্যাটেল এবং তার ডেপুটি কৌশলী আমলা ভি পি মেনন এ ত্রয়ী শক্তির মুখোমুখি হয়ে প্রিন্সরা দেখলেন, তাদের সামনে নড়াচড়ার খুব বেশি জায়গা নেই। তাদের বলা হলো, আপনারা ভারতে যোগ দিন, তাহলে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং যোগাযোগ- এ তিন বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে আপনাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে; আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতেও হাত দেয়া হবে না। কিন্তু যদি এটা করতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে আপনাকে আপনার প্রজাদের হাতে উৎখাত হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে। কেউ আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না।
ভারতের মানচিত্রে আমূল বদল : সমূহ বিপদের আশঙ্কা এবং নিজেদের অসহায়তা বুঝতে পেরে বেশিরভাগ প্রিন্সই ভারতে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। অল্প যে কয়েকজন বিরোধিতা করেছিলেন (যেমন- জুনাগড়, কাশ্মির এবং হায়দ্রাবাদের শাসকরা), তাদের শেষ পর্যন্ত বন্দুকের মুখে ভারতের অংশ করা হয়েছিল। হায়দ্রাবাদের তথাকথিত পুলিশি অ্যাকশনে ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। খুব শিগগিরই এ প্রিন্সদের সঙ্গে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা ভাঙা হলো। অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান রাজ্য ওড়িশা বা নতুন-সৃষ্ট রাজস্থানের অঙ্গীভূত হতে বাধ্য করা হলো। যেসব রাজ্য অপেক্ষাকৃত বড় ছিল এবং ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছিল (যেমন- গোয়ালিয়র, মহীশূর, যোধপুর এবং জয়পুর), সেগুলোকে প্যাটেল ও মেনন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাদের স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু তাদেরও বৃহত্তর প্রশাসনিক অঞ্চলের অংশ করে নেয়া হলো। এভাবেই ভারতের মানচিত্র অনেকটা আজকের মতো দেখতে হয়ে উঠল।
রাজ্যগুলোর সংযুক্তি লাভজনক প্রক্রিয়া : সন্দেহ নেই, দেশীয় রাজ্যগুলোর এ সংযুক্তিকরণ ছিল ভারতের জন্য একটা লাভজনক প্রক্রিয়া। দেশভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে ভারত যা হারিয়েছিল, তার প্রায় সমান ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা তারা পেয়ে গেল। এর সঙ্গে ছিল নগদ অর্থ এবং বিনিয়োগ; যার মূল্যমান ছিল ১০০ কোটি রুপি। যা এখনকার হিসেবে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪শ কোটি রুপি। এর বিনিময়ে রাজ্যগুলোর সাবেক শাসকদের দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন অংকের করমুক্ত তহবিল। মহীশূরের মহারাজা পেতেন বার্ষিক ২০ হাজার পাউন্ড সমমানের অর্থ। আর ছোট রাজ্য কাটোডিয়ার তালুকদার পেতেন বার্ষিক ৪০ পাউন্ড। এ তালুকদার কেরানির চাকরি করতেন। টাকা বাঁচানোর জন্য সর্বত্র সাইকেল চালিয়ে যেতেন। এ ব্যবস্থা চলেছিল দুই দশক ধরে। এসব রাজকীয় পরিবারের নারী ও পুরুষ সদস্যরা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। নেহরুর কন্যা ইন্দিরা যখন কংগ্রেসের নেত্রী, তখন তাদের কয়েকজন কংগ্রেসে যোগ দেন। তবে বেশিরভাগই যোগ দিয়েছিলেন বিরোধী দলগুলোতে।
বাবার মতোই যিনি প্রিন্সদের মানতেন না : ইন্দিরা গান্ধী পিতার মতোই এ প্রিন্সদের দেখতে পারতেন না। প্রিন্সদের অনেকেই কংগ্রেসের প্রার্থীদের হারাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের এ সাফল্য ইন্দিরার পার্লামেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষয় ধরিয়েছিল। ইন্দিরা ভেবেছিলেন, তিনি এ প্রিন্সদের স্বীকৃতি বাতিল করলে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। তাই তিনি তার একজন প্রেসিডেন্টকে দিয়ে এ চেষ্টা করিয়েছিলেন। তবে সুপ্রিমকোর্টে এ প্রয়াস আটকে যায়। কোর্ট রায় দেয়, এ ধরনের কোনো আদেশ জারি করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই। তবে ইন্দিরা তাতে দমে যাননি। কংগ্রেস ১৯৭১ সালের নির্বাচনের পর দুই-তৃতীয়াংশ পার্লামেন্টারি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর তিনি সফলভাবে লোকসভায় একটি বিল আনেন সংবিধান সংশোধনের। এর মধ্য দিয়ে প্রিন্সদের উপাধি, সুযোগ-সুবিধা এবং সরকারি তহবিল পাওয়া বন্ধ হয়।
ক্ষমতার খেলায় যাদের হাতে তাসও ওঠেনি : ইন্দিরার মতো ছিল, এ প্রথার অবসানের সময় এসে গেছে। যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা আমাদের সমাজে নেই। দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রিন্সদের সাবেক দরবার কক্ষে এ প্রতারণার বিরুদ্ধে যত হৈচৈই হয়ে থাকুক আধুনিক বিশ্বে তেমন কেউ এতে কর্ণপাত করেনি। খুব কম ভারতীয়ই এতে শোক প্রকাশ করেছিলেন। ভারত-ব্রিটেনের মতো নয়, এখানকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। তবে যেভাবে এ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়েছিল, তা প্রায়ই সোজা পথে চলেনি। ক্ষমতার খেলায় এ প্রিন্সদের হাতে সুবিধামতো তাসও ওঠেনি।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী