ইউক্রেনের দিনিপ্রো শহরে হামলা চালাল একটি রুশ বিমান। যাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা অস্বাভাবিক হামলা বলছেন। হামলাটি এমন এক বিস্ফোরণ ঘটায়, যা তিন ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। এ আক্রমণে এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, যা ভীষণ শক্তিশালী। এতটাই শক্তিশালী যে, ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা একে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)-এর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে জানিয়েছে। তবে পশ্চিমা কর্মকর্তারা সেটি অস্বীকার করে বলেছেন, এমন হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক সতর্কতা জারি করত। হামলার কয়েক ঘণ্টা পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন ভাষণে জানান, রাশিয়া নতুন প্রচলিত মাঝারি-পাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে। যার কোডনাম ওরেশনিক (রুশ ভাষায় যার অর্থ হ্যাজেল গাছ)। হ্যাজেল গাছ বেশ বড় আকারের ঝোপ জাতীয় গাছ। যার পাতাগুলো চারদিকে গুচ্ছ হয়ে ছড়িয়ে থাকে। গাছটির অবয়বের সঙ্গে বিস্ফোরণের সদৃশ রয়েছে। পুতিন জানান, ক্ষেপণাস্ত্রটি ম্যাক ১০ (শব্দের গতির দশগুণ), অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার গতিতে চলেছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এ অস্ত্রটি প্রতিহত করার উপায় নেই। দিনিপ্রোয় একটি বড় সামরিক-শিল্প স্থাপনায় এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ওই শিল্প স্থাপনাটি সামরিক সরঞ্জাম ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতো। তিনি একে একটি পরীক্ষামূলক হামলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা সফল হয়েছে। কারণ, ক্ষেপণাস্ত্রটি তার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পেরেছে। পরের দিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার সময় পুতিন বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষা চলতে থাকবে।
ক্ষেপণাস্ত্রের বর্ণনা : পুতিনের বর্ণনার পরও এ ক্ষেপণাস্ত্র আসলে কী, তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট ঐকমত্য নেই। ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, এটি একধরনের নতুন আইসিবিএম, যার নাম কেদর (সিডার গাছ)। তারা বলেন, এটি ম্যাক ১১ গতিতে এগিয়েছে এবং উৎক্ষেপণ স্থল রাশিয়ার আস্ট্রাখান থেকে ১ হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল) দূরে অবস্থিত ইউক্রেনের দিনিপ্রোতে পৌঁছাতে ১৫ মিনিট সময় নিয়েছে। তারা আরো জানায়, ক্ষেপণাস্ত্রটিতে ছয়টি ওয়ারহেড ছিল। প্রতিটিতে আরো ছয়টি সাব-মিউনিশন ছিল। ওয়ারহেড হলো ক্ষেপণাস্ত্রের সম্মুখ অংশ; যাতে বিস্ফোরক এজেন্ট থাকে এবং সাব মিউনিশন হলো বিস্ফোরক; যা ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড থেকে ছাড়া হয়। এগুলো একটি ক্যানিস্টারে থাকে; যা পরে মধ্য-আকাশে খুলে যায় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হয়। গণমাধ্যমের ভেরিফাইয়ের ভিডিও বিশ্লেষণেও এ দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। ভিডিও ফুটেজগুলো যদিও বেশ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের। এরপরও রাতের আকাশে ছয়টি ফ্ল্যাশ বা আলোর ঝলক দেখা যায়। প্রতিটি ফ্ল্যাশে আরও ছয়টি পৃথক প্রজেক্টাইল দেখা যায়।
গতি কেন গুরুত্বপূর্ণ : পুতিনের বক্তব্য অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্রটি হাইপারসনিকের সংজ্ঞার ওপরের স্তরে রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের গতি যত বেশি হয়, এটি লক্ষ্যবস্তুতে তত দ্রুত পৌঁছায়। ফলে হামলার শিকার দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার সময় কমে যায়। একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত বায়ুমণ্ডলের ওপরের দিকে একটি ধনুকাকৃতির পথে ওঠে। একইভাবে বাঁকা পথে নিচে নেমে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। তবে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নেমে আসার সময় ক্ষেপণাস্ত্রের গতি আরও বাড়তে থাকে। কাইনেটিক এনার্জি বা গতিশক্তি অর্জন করে। এ গতিশক্তি আরও সুযোগ তৈরি করে দেয়। এটি লক্ষ্যবস্তুর দিকে নামার সময় নিজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এজন্য ক্ষেপণাস্ত্রটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষামূলক কৌশল প্রয়োগ করে। এ কারণে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন ইউক্রেনের ইউএস-নির্মিত প্যাট্রিয়ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) দিয়ে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা বাধা দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের হুমকি অবশ্য সামরিক বাহিনীর (বিশেষ করে, যারা এ ধরনের ঝুঁকি প্রতিরক্ষায় কাজ করে) তাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ক্ষেপণাস্ত্রের গতি যত বেশি হবে, একে প্রতিরোধ করা তত কঠিন হবে। এ কারণেই পুতিন সম্ভবত এ নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে বলার সময় এর গতির ওপর জোর দিয়েছেন। রাশিয়ার ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ ইউক্রেন প্রতিরোধ করেছে। প্রতিরোধের এ সাফল্য খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু এ দ্রুতগতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্দেশ্য হলো, সেই শতাংশ কমিয়ে আনার চেষ্টা করা।
নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা : রুশ সামরিক বিশেষজ্ঞ ইলিয়া ক্রামনিক বলেন, ওরেশনিক সম্ভবত মধ্যমণ্ডপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন প্রজন্ম। এ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার (১,৫৫০-১,৮৬০ মাইল) এবং সম্ভবত ৫ হাজার কিলোমিটার (৩,১০০ মাইল) পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৫ হাজার কিলোমিটারের দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এটি আঘাত হানতে সক্ষম। তবে এটি কোনো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নয়। এতে নিশ্চিতভাবে এমন একটি ওয়ারহেড রয়েছে, যা আলাদা হয়ে যেতে পারে; যার প্রতিটির নিজস্ব গাইডেন্স ইউনিট বা গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ইয়ারস-এম ক্ষেপণাস্ত্রের একটি ছোট সংস্করণ হতে পারে। যা কি না একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাশিয়া গত বছর এ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণ তৈরি শুরু করে, যেখানে আরও গতিসম্পন্ন ও স্বাধীন ওয়ারহেড যুক্ত করা হয়। বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি করনেভের মতে, ওরেশনিক সম্ভবত ছোট পাল্লার ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে তৈরি; যা ইউক্রেনে প্রায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এবারে এতে নতুন প্রজন্মের ইঞ্জিন যোগ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত বসন্তে রাশিয়ার কাপুস্তিন ইয়ার টেস্টিং সাইটে একটি বড় ইঞ্জিনযুক্ত ইস্কান্দার পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়; যা সম্ভবত ওরেশনিক হতে পারে। বৃহস্পতিবার যে ক্ষেপণাস্ত্রটি ইউক্রেনে নিক্ষেপ করা হয়, সেটি ওই একই স্থান থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল।
যতটা কার্যকর হতে পারে : সামরিক বিশ্লেষক ভ্লাদিস্লাভ শুরিগিন রুশ সংবাদমাধ্যম ইজভেস্টিয়াকে বলেছেন, ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্র আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে ভেদ করার ক্ষমতা রাখে। এটি পারমাণবিক ওয়ারহেড ব্যবহার না করেও গভীর সুরক্ষিত বাঙ্কার ধ্বংস করতে পারে। তবে দিনিপ্রোর কারখানায় কোনো ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। আরেক রুশ বিশ্লেষক, ইগর কোরোচেঙ্কো, সংবাদ সংস্থা তাসকে জানান, এ ক্ষেপণাস্ত্রে অনেকগুলো স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রিত ওয়ারহেড রয়েছে। ওয়ারহেডগুলো লক্ষ্যবস্তুতে প্রায় একসঙ্গে পৌঁছে যায়; যা অত্যন্ত কার্যকর। রিস্ক অ্যাডভাইজারি কোম্পানি সিবিলিনের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন ক্রাম্প জানান, এ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এ সংঘাতে রাশিয়ার স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এরই মধ্যে ইউক্রেনের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত এবং উন্নত সিস্টেম এ হুমকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।