ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ১৯৮৭ সালে আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিন আবদুল আজিজ আর-রান্তিসির হাত ধরে এর যাত্রা শুরু। পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ছিল তাদের দাবি। যুগের পর যুগ হামাসের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ যোদ্ধা সবাই দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়েছেন। তাই ফিলিস্তিনিদের কাছে তারা মুক্তির নায়ক। অন্যদিকে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তাদের ভাষায়, হামাসের যোদ্ধারা একেকজন ‘সন্ত্রাসী’। হামাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আঘাতও এসেছে অসংখ্যবার। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, জর্জরিত হয়েছে; এরপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে হামাস। তবে ২০২৪ সালের মতো বড় আঘাতের মুখোমুখি হয়তো এর আগে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্ব আর কখনোই হয়নি। বিদায়ী বছরে একের পর এক নেতা হারিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ করছে হামাস। চলমান যুদ্ধে হামাসের কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে তাদের। এর আগে গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালায় হামাস। ইসরায়েলের ইতিহাসে একে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা বলা হচ্ছে। ওইদিন ফিলিস্তিনের গাজায় পাল্টা হামলা চালিয়ে হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। তবে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে নির্বিচার হামলা চালিয়ে শিশু-নারীসহ বেসামরিক নাগরিকদের বেশি হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েল সরকার ও হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আর প্রায় ১৫ মাস ধরে চলমান গাজা যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৩৫০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ হাজার শিশু রয়েছে। ২০২৪ সালে হামাসের ওপর প্রথম বড় আঘাত আসে গত ১৩ জুলাইয়ে। ওইদিন গাজায় মুহাম্মদ দেইফ নিহত হন।
মুহাম্মদ দেইফ : হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসেম ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ দেইফ। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে চালানো হামলার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ধরা হয় তাকে। মুহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬৫ সালে, খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এ শরণার্থী শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নাম ছিল মুহাম্মদ মাসরি। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার পর তিনি হামাসে যোগ দেন। তখন তার নাম হয় মুহাম্মদ দেইফ। ১৯৮৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। তখন টানা ১৬ মাস কারাগারে ছিলেন। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন দেইফ। পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কমিটির প্রধান ছিলেন। গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অসংখ্য টানেল বা সুড়ঙ্গ রয়েছে। এ নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন দেইফ। তিনি হামাসের বোমা বানানোর প্রকল্পে ভূমিকা রেখেছেন। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় দেইফের নাম ছিল। এর আগে ইসরায়েলের হত্যাচেষ্টায় দেইফ একটি চোখ হারান। পায়েও গুরুতর আঘাত পান। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের বিমান হামলায় দেইফের স্ত্রী, সাত মাসের পুত্রসন্তান এবং তিন বছর বয়সী মেয়ের মৃত্যু হয়। বারবার আঘাত, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, গোপন জীবন, পরিবারের সদস্যদের হত্যা- কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ১৩ জুলাই ইসরায়েল জানায়, গাজার খান ইউনিস এলাকায় বিমান হামলায় দেইফ নিহত হয়েছেন।
ইসমাইল হানিয়া : গত ৩১ জুলাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এলো, হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া তেহরানে নিহত হয়েছেন। নড়েচড়ে বসে বিশ্ব। ইরানের কোনো ঘটনার তথ্য যাচাই করা বেশ কঠিন। ভরসা তেহরান বা হামাসের আনুষ্ঠানিক বয়ান। হানিয়ার নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রথম মুখ খোলে ইরান। দেশটি জানায়, তেহরানের একটি অতিথিশালায় ‘সন্ত্রাসী হামলায়’ শহিদ হয়েছেন হানিয়া। পরে ইরান ও হামাস দাবি করে, ইসরায়েল হানিয়াকে খুন করা হয়েছে। নিহত হওয়ার একদিন আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন হানিয়া। সেখানে পেজেশকিয়ান ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একজন রাষ্ট্রীয় অতিথিকে কীভাবে হত্যা করা সম্ভব হলো, তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তেহরান। ওই সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, তেহরানে হানিয়া যেই কক্ষে ছিলেন, সেখানে কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই বোমা স্থাপন করে রেখেছিল ইসরায়েল। সেই বোমা বিস্ফোরণে হানিয়ার মৃত্যু হয়েছে। কেউ দাবি করে, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানিয়ার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ইরান ও হামাসের অভিযোগের বিষয়ে এতদিন চুপ ছিল ইসরায়েল। অবশেষে গত ২৩ ডিসেম্বর ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার কথা প্রথমবারের মতো স্বীকার করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
ইসমাইল হানিয়া ১৯৬৩ সালে গাজার আশ-শাতি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তরুণ বয়সে গাজা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাত্র শাখার সদস্য ছিলেন। ১৯৮৭ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাকালে সংগঠনটিতে যোগ দেন। প্রথম ইন্তিফাদার সময় হানিয়াকে বেশ কয়েকবার আটক করে কারাদণ্ড দেয় ইসরায়েল। পরে তাকে দক্ষিণ লেবাননে ছয় মাসের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয়। ২০০৩ সালে হানিয়া ও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিনকে একসঙ্গে হত্যার চেষ্টা করে ইসরায়েল। তারা যে বাড়ি অবস্থান করছিলেন, সেখানে বোমা নিক্ষেপ করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। তবে বেঁচে যান দুজনই। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে হানিয়ার নামডাক বাড়তে থাকে। কিন্তু খুব দ্রুতই প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাত্তাহর সঙ্গে হামাসের ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থাপনায় ফাটল ধরে। দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজায় ফাত্তাহর কার্যক্রম বন্ধ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়াকে সরিয়ে দেয়া হয়। জবাবে ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্টের অনুগতদের সরিয়ে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে তিনি হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন।
ইয়াহইয়া সিনওয়ার : তেহরানে ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর হামাসের রাজনৈতিক শাখার নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান ইয়াহইয়া সিনওয়ার। এর আগে গাজায় সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিসে জন্ম নেন ইয়াহইয়া সিনওয়ার। তাকে হামাসের সবচেয়ে অনমনীয় শীর্ষ নেতা বিবেচনা করা হতো। ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে সোচ্চার ভূমিকা রাখায় আশির দশকের শুরুর দিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে বারবার গ্রেপ্তার হন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যোদ্ধাদের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সিনওয়ার সহায়তা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এ নেটওয়ার্ক হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসেম ব্রিগেড হিসেবে গড়ে ওঠে।
হামাস প্রতিষ্ঠার পরপরই এর নেতৃত্বের কাতারে আসেন ইয়াহইয়া সিনওয়ার। বছরখানেকের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে ও চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ইয়াহইয়া সিনওয়ার দীর্ঘ ২৩ বছর ইসরায়েলের কারাগারে কাটিয়েছেন। পরে এক বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১১ সালে মুক্তি পান। এরপর দ্রুতই সিনওয়ার হামাসের শীর্ষ পদে ফেরত আসেন। ২০১২ সালে সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পান সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের সঙ্গে রাজনৈতিক শাখার কার্যক্রম সমন্বয়ের। ২০১৪ সালে গাজায় সাত সপ্তাহ ধরে ব্যাপক হামলা ও অভিযান চালায় ইসরায়েল। ওই সময় হামাসের উভয় শাখায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন সিনওয়ার। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র তাকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে। এরপর ২০১৭ সালে সিনওয়ার হামাসের গাজা শাখার প্রধান হন।
গত ১৬ অক্টোবর দক্ষিণ গাজায় এক অভিযান চালিয়ে ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হত্যার কথা জানায় ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের চোখে তিনি ছিলেন ‘এক নম্বর’ শত্রু। দক্ষিণ গাজার তেল আস-সুলতান এলাকায় তল্লাশি-অনুসন্ধান চালানোর সময় সিনওয়ারকে পেয়ে যায় ইসরায়েলের পদাতিক সেনারা। এলাকাটিতে হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য অবস্থান করছেন ভেবে অভিযান চালাচ্ছিল ইসরায়েলি সেনারা। সেখানে সিনওয়ারের থাকার বিষয়টি জানত না তারা। অভিযানকালে সেনারা তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ভবনের মধ্য দিয়ে সরে যেতে দেখে। একপর্যায়ে তারা গুলি চালায়। দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় সিনওয়ার সরে গিয়ে একটি বিধ্বস্ত ভবনে ঢুকে পড়েন। ইসরায়েলের গণমাধ্যম জানায়, পরবর্তী সময়ে ভবনটি লক্ষ্য করে ট্যাংক দিয়ে একাধিক গোলা ও একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এতে নিহত হন সিনওয়ার। তবে নিহত হওয়ার পরও ইসরায়েলি সেনারা বুঝতে পারেনি, তারা এক নম্বর শত্রুকে হত্যা করেছে। পরে ডিএনএ পরীক্ষা করে ইয়াহইয়া সিনওয়ারের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
সালেহ আল-আরৌরি : হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সালেহ আল-আরৌরি গত ২ জানুয়ারি নিহত হন। সালেহ সংগঠনের সামরিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ছিলেন। হামাস আর হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রধান যোগাযোগকারীও ছিলেন তিনি। লেবাননের বৈরুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন সালেহ। ১০ মার্চ গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের নিচে একটি সুড়ঙ্গে বোমা হামলায় নিহত হন হামাসের ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ঈসা। তাকে ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর হামলার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ধরা হয়। এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর গাজার উত্তরাঞ্চলে এক অভিযানে হামাসের কেন্দ্রীয় জাবালিয়া ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ইবরাহিম বিয়ারিকে খুন করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী