দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের একটি উড়োজাহাজ রোববার সকালে ১৭৫ যাত্রী, ৬ ক্রুসহ মোট ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বাকিরা নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির ইতিহাসে এত বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এটাই প্রথম।
যা ঘটেছিল : জেজু এয়ারের উড়োজাহাজটি বোয়িংয়ের ৭৩৭-৮০০ মডেলের। সুলভ টিকিটের এ পরিবহন সংস্থার উড়োজাহাজটি ব্যাংকক থেকে এসেছিল। গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দরে রোববার সকাল ৯টার একটুপর অবতরণের প্রথম চেষ্টার সময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে উড়োজাহাজটিকে পাখির আঘাতের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। আরও কয়েক মিনিট পর উড়োজাহাজটির পাইলট ‘মে-ডে’ (বিপন্ন অবস্থা) সতর্ক সংকেত ব্যবহার করেন। এরপর উড়োজাহাজটি আবার অবতরণের চেষ্টা করে। এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গিয়ার চালু না করে উড়োজাহাজটি ইঞ্জিনের দিক বা শেষের অংশ (বেলি ল্যান্ডিং) দিয়ে অবতরণের চেষ্টা করছে। নাটকীয় সেই ভিডিওতে দেখা যায়, উড়োজাহাজটি রানওয়েতে এঁকেবেঁকে ছুটছে। এর শেষ অংশ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। রানওয়ে থেকে ছিটকে উড়োজাহাজটি একটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে।
দুর্ঘটনার কারণ : দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানেন এমন কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পাখির আঘাত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, উড়োজাহাজটি রানওয়ের কালো অংশের বাইরে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খায়। তাই রানওয়ে ছোট হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা, এমন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সম্ভবত এটা দুর্ঘটনার কোনো কারণ নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, রানওয়েটি ২ হাজর ৮০০ মিটার লম্বা। কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়া এ আকারের রানওয়ে নিরাপদে ব্যবহার করা হচ্ছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটি থেকে ব্ল্যাক বক্স সংগ্রহ করা হয়েছে। এখান থেকে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
পাখির আঘাত যতটা ভয়ঙ্কর : উড়োজাহাজে পাখির আঘাত বলতে কোনোর পাখির সঙ্গে চলন্ত উড়োজাহাজের সংঘাতকে বোঝায়। পাখির আঘাত উড়োজাহাজের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) মনে করে, ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে গেলে উড়োজাহাজ শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। পাখির আঘাতের কারণে সারা বিশ্বে অনেক ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাখির আঘাতের কারণে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারওয়েজ এয়ারবাসের এ-৩২০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরিভিত্তিতে অবতরণ করেছিল। তখন উড়োজাহাজটির দুই ইঞ্জিনেই পাখি আঘাত করেছিল। কিন্তু কেউ মারা না যাওয়ায় এ দুর্ঘটনাকে ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ বলা হয়।
যেখান থেকে এসেছিল : দক্ষিণ কোরিয়ার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে উড্ডয়ন করেছিল। অবতরণ করার কথা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরটি রাজধানী সিউলের ২৮৮ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
যাত্রীদের খবরাখবর : উড়োজাহাজটিতে ১৭৫ যাত্রী, ৬ ক্রুসহ মোট আরোহী ছিলেন ১৮১ জন। উদ্ধারকর্মীরা দুজনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। দুজনই ফ্লাইট পরিচালক। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত মানুষের সংখ্যা ১৭৯। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে ১৭৬ জনের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে নারী ৮৩ জন, পুরুষ ৮২ জন; আর ১১ জনের লিঙ্গ সম্পর্কে তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হয়নি। কর্মকর্তারা বলেন, উড়োজাহাজটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
উদ্ধার অভিযান : উদ্ধার কাজে সেনাসদস্যসহ কয়েক শ অগ্নিনির্বাপণ ও অন্যান্য জরুরি বিভাগের কর্মীরা অংশ নিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুর্ঘটনাস্থলকে বিশেষ দুর্যোগ এলাকা ঘোষণা করেছেন। কর্তৃপক্ষগুলো জানিয়েছে, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা মুয়ান বিমানবন্দরের প্রথম তলায় অপেক্ষা করছেন।
নিরাপত্তা রেকর্ড : দক্ষিণ কোরিয়ার উড়োজাহাজ চলাচলের নিরাপত্তার রেকর্ড বেশ ভালো। জেজু এয়ারের কোনো উড়োজাহাজের বিধ্বস্ত হওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা। এর আগে জেজু এয়ারের বোম্বার্ডিয়ার কিউ-৪০০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ ৭৪ যাত্রী নিয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়েছিল। প্রবল বাতাস ছিল এ দুর্ঘটনার কারণ। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের বুসান-গিমহে বিমানবন্দরে ২০০৭ সালের ১২ আগস্টের এ দুর্ঘটনায় অনেকে আহত হলেও কেউ নিহত হননি।
সরকারের উদ্যোগ : দক্ষিণ কোরিয়া সম্প্রতি গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক মাসের মধ্যে দেশটি তিনজন প্রেসিডেন্ট দেখল। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং মক দায়িত্ব গ্রহণের তিনদিনের মাথায় এ দুর্ঘটনা ঘটল। উদ্ধার অভিযান ও অন্যান্য করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে তিনি এরই মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সাত দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে।