ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় রোববার স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজিদ আল-আনসারি এক বিবৃতিতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে এ যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার তথ্য জানান। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এ হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হন। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় আড়াই শ জনের বেশি মানুষকে। তাদের মধ্যে অনেককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। হামাসের হামলার দিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরাইল। গাজা কর্তৃপক্ষের হিসেবে এ হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ; বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো মানুষ। ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘ ১৫ মাস পর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে থামল ইসরাইলের নৃশংসতা। বন্ধ হলো নির্বিচার হামলা। আসতে শুরু করল ত্রাণ। বাসিন্দাদের মধ্যে এখন কিছুটা স্বস্তির ছোঁয়া। ইসরাইলিদের মধ্যেও আনন্দের রেশ কম নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা মিলিত হচ্ছেন গাজায় হামাসের হাতে বন্দি থাকা জিম্মিদের সঙ্গে।
যুদ্ধবিরতির সময়টা যেমন : বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও আগামী কয়েক সপ্তাহ কঠিন হতে চলেছে।’ দেরিতে যুদ্ধবিরতি হলেও গাজাবাসী আনন্দ উদ?যাপন করতে দেরি করেননি। শোনা যাচ্ছে আতশবাজি পোড়ানো ও পটকা ফোটানোর শব্দ। সকাল থেকে গাজায় নিজ নিজ এলাকায় ফেরা শুরু করেন লোকজন। এমনই একজন আনোয়ার। গাজার দক্ষিণে রাফায় নিজ বাড়ি ফিরছেন তিনি। আনোয়ার বলেন, ‘আল্লাহর শোকরিয়া। আশা করি, যুদ্ধবিরতি চলতে থাকবে।’ ২০২৩ সাল থেকে যুদ্ধবিরতির বহু চেষ্টা হলেও আশার আলো দেখা যায়নি। তবু যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় চলছিল সমঝোতার প্রচেষ্টা। এরই মধ্যে ১৫ জানুয়ারি কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দোহায় আলোচনার পর যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন হামাস ও ইসরাইলের প্রতিনিধিরা। গাজা যুদ্ধে ইসরাইলকে এককাট্টা সমর্থন দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টাও কম করেনি। এ নিয়ে তৎপর ছিলেন নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপের ছয় সপ্তাহে ৩৩ জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবেন ইসরাইলের কারাগার থেকে; গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো হবে এবং ইসরাইলি সেনাদের একাংশকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। তবে যুদ্ধবিরতির প্রথম ছয় থেকে সাত সপ্তাহের সময়টা কঠিন হবে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেকেলবার্গ। তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের বর্তমান সরকারের এ যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি এজেন্ডা রয়েছে। তারা গাজা দখল করে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিতে চায়।’
সন্তানের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনি মা : যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ৩৩ জনের তালিকা ইসরাইলকে দিয়েছে হামাস। এর মধ্যে তিনজনকে রোববার মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি। তাদের বরণ করে নিতে তেল আবিবে ইসরাইলিদের জড়ো হতে দেখা যায়। এ জিম্মিদের মুক্ত করতে ১৫ মাস ধরে আন্দোলন করেছেন তারা। এদিকে প্রায় ৯০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়ার কথা ইসরায়েলের। দেশটির বিভিন্ন কারাগারে তারা বন্দী। তাদের মধ্যে নিজের দুই সন্তানও রয়েছেন বলে জানান দখলকৃত পশ্চিম তীরের এক নারী। তিনি বলেন, ‘সন্তানদের মুক্তির খবর শুনে প্রথমে হতবাক হয়েছিলাম। আমি কাঁপছিলাম।’
গাজায় ঢুকছে ত্রাণের গাড়ি : গত ১৫ মাসে ইসরাইলের হামলায় গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেখানকার ২৩ লাখ বাসিন্দা। শীত, ক্ষুধা, তৃষ্ণা পরিস্থিতি আরও বিভীষিকাময় করেছে। এরই মধ্যে গাজা সীমান্তে ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক জড়ো হয়। প্রায় ২০০ ট্রাক গাজায় প্রবেশের জন্য মিসর-সীমান্তে অপেক্ষায় ছিল। যুদ্ধবিরতি শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথম ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক-বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ওসিএইচএ) প্রধান জোনাথন হুইটল। অনেকদিন পর শরণার্থী শিবির ছেড়ে প্রথমবারের মতো নিজ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন গাজাবাসী। যদিও তাদের এ স্বস্তি কত দিন টিকবে, তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তবে যুদ্ধবিরতির চুক্তির প্রতি হামাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র আবু উবাইদা। তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের সদিচ্ছার ওপর এ প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করবে।’
দখলদারি বন্ধ হওয়া একমাত্র উপায় : ইসরাইল সরকারের কট্টর ডানপন্থিদের অনেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। যুদ্ধবিরতি ইসরাইলের মন্ত্রিসভায় পাস হলে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন তারা। যেমন- জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভির যুদ্ধবিরতি শুরুর পর পদত্যাগ করেছেন। বোঝা যায়, ফিলিস্তিনিদের রক্তপাত নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এটি যে সত্য, তা প্রমাণিত হয় রোববারের একটি ঘটনায়। যুদ্ধবিরতি যখন বিলম্ব হচ্ছে, সেই তিন ঘণ্টায়ও গাজায় হামলা চালাতে ছাড়েনি ইসরাইল। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন। ফিলিস্তিনিদের ওপর এ নৃশংসতা বন্ধের একমাত্র উপায় দখলদারি বন্ধ করা, এমনটা মনে করেন দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমত। কারমত বলেন, ‘ইসরাইলিরা দাবি করতে পারে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিবর্তন এনেছে, হিজবুল্লাহকে দুর্বল করেছে, সিরিয়ায় সরকার পতন করেছে। তবে ফিলিস্তিনে এখনও তারা দখলদারির নীতিতে আটকে রয়েছে। এ দখলদারি যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন ফিলিস্তিনের এ সংঘাত থামবে না।’
যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিশ্বনেতাদের মতামত : বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তির কথা নিশ্চিত করে জো বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ চুক্তি গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করবে, ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা বাড়াবে। ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে বন্দি থাকার পর জিম্মিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের পুনর্মিলন ঘটাবে। এ পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা আমি ২০২৪ সালের ৩১ মে (জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে) তুলে ধরেছিলাম। উপস্থাপনের পর তা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেছিল। লেবাননে যুদ্ধবিরতি ও ইরান দুর্বল হওয়ার পরে হামাস যে ব্যাপক চাপে ছিল এবং আঞ্চলিক সমীকরণ যেভাবে বদলে গিয়েছিল, এ যুদ্ধবিরতি কেবল সেটারই ফলাফল নয়; বরং আমেরিকার দৃঢ় ও কষ্টসাধ্য কূটনীতিরও ফল। এটা সম্পন্ন করার জন্য তাদের (কূটনীতিকদের) প্রচেষ্টায় আমার কূটনীতি কখনও থেমে থাকেনি।’ নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এ বিষয়ে ট্রাম্প লিখেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে জিম্মিদের জন্য আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে। খুব শিগগির তাদের মুক্তি দেয়া হবে। এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমার জাতীয় নিরাপত্তা দল ইসরাইল এবং আমাদের মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাবে; যাতে গাজা আর কখনও সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল না হয়।’
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন জসিম আলে সানি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠক শেষে গতকাল সন্ধ্যায় দোহায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তিনি এখন থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের এক পোস্টে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানান। তিনি গাজায় দ্রুত মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতিসংঘ এ চুক্তিকে সমর্থন করতে এবং এখনও ভোগান্তিতে থাকা অগণিত ফিলিস্তিনির জন্য টেকসই মানবিক ত্রাণ সরবরাহ বাড়াতে প্রস্তুত ছিল।’ তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান আঙ্কারায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাত সমাধানের জন্য তুরস্কের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন যুদ্ধবিরতি চুক্তির খবরকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জিম্মিদের তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে পুনর্মিলন করা হবে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছাবে। এটি একটি পুরো অঞ্চলে আশা জাগিয়ে তুলেছে, যেখানে মানুষ দীর্ঘকাল ধরে অপরিসীম দুর্ভোগ সহ্য করেছে। উভয় পক্ষকে এ চুক্তি অবশ্যই পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যা এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানে সহায়তা করবে।’
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেন, ‘এ মুহূর্তে আশা করা যায়, অবশেষে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং গাজায় প্রাণহানি বন্ধ হবে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মাসের পর মাস ধরে ভয়াবহ রক্তপাত এবং অগণিত প্রাণহানির পর অবশেষ সেই দীর্ঘ বিলম্বিত খবর এলো, যার জন্য ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি জনগণ মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।’ বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার ডি ক্রু বলেন, ‘দীর্ঘ সংঘাতের পর জিম্মিদের বিষয়ে আমরা বেশ স্বস্তিবোধ করছি। আশা করি, এ যুদ্ধবিরতি যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এবং একটি টেকসই শান্তির সূচনা করবে। বেলজিয়াম সাহায্য করতে প্রস্তুত।’ নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস গাহর স্টোয়ের গাজাসহ (সমগ্র ফিলিস্তিনের) পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ফিলিস্তিনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ইসরাইল ও ফিলিস্তিন উভয়কেই বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেতে হবে এবং এ সমাধান আঞ্চলিকভাবে স্থির করতে হবে।’
লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী