ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ার (জার্মানি) : সতেরো শতক থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এ মেলা। প্রতিবছর জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের ফ্রাংকফুর্ট ট্রেড ফেয়ার গ্রাউন্ডে মধ্য অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় এ বইমেলা। ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় বাণিজ্যিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। আর দর্শনার্থীর আগমনের দিক থেকে ইউরোপে এর অবস্থান দ্বিতীয়। পাঁচ দিনব্যপী মেলার প্রথম তিনদিন থাকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশে আগমনকারীদের জন্য। পরবর্তী দুদিন মেলা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। মেলায় প্রায় ২ লাখ ৮৬ হাজার দর্শনার্থী আসেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজারই বাণিজ্যিক উদ্দেশে আসেন।
মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (রাশিয়া) : শরতের সময় আয়োজিত এ বইমেলা প্রথম শুরু হয় ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে প্রতিবছর ৩ থেকে ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মস্কো এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার। এখানে রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো অংশ নেয়। পাঠকরা বিশেষ মূল্যে বই কিনতে পারেন।
কায়রো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (মিসর) : আরববিশ্বের প্রাচীন ও বৃহত্তম বইমেলা হলো কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। এ বইমেলা জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। কায়রো শহর প্রতিষ্ঠার এক হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৯ সালে এ বইমেলার সূচনা। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই মাদিনাতু নাসারের কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার গ্রাউন্ডে এ মেলার আয়োজন করে ‘জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অর্গানাইজেশন’। প্রায় ২০ লাখ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ আয়োজন।
লন্ডন বুক ফেয়ার (যুক্তরাজ্য) : বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা হলো লন্ডন বুক ফেয়ার। ১৯৭১-এর ৫ নভেম্বর এ মেলার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি দেশ এ মেলায় অংশ নেয়। ইউরোপিয়ান প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্টদের তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত লন্ডন বুক ফেয়ার। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ মেলা চলত অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে। সে বছর এটি সরিয়ে নেয়া হলেও ২০১৫ সালে আবার সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে সেখানেই এ আয়োজন চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বুক এক্সপো আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) : ১৯৪৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘আমেরিকান বুকসেলার অ্যাসোসিয়েশনের কনভেনশন এবং ট্রেড শো’ নামে শুরু হয় বই নিয়ে এ আয়োজন। ১৯৭১ সালে নাম বদলে ‘বুক এক্সপো আমেরিকা’ রাখা হয়। দেশটির বড় বড় শহরে পালাক্রমে চলে এ বইমেলা। ২০০৮-এ লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক সিটিতে ২০০৯-১৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে শিকাগোয় হয়েছে এ মেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘দ্য বুককর্ন’। যা মূলত গল্প বলা ও সংস্কৃতি প্রদর্শন। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বইমেলা।
বলগ্না চিলড্রেনস বুক ফেয়ার (ইতালি) : শিশুসাহিত্যের জন্য ‘বলগ্না চিলড্রেনস বুক ফেয়ার’ একটি প্রধান বইমেলা। বিশ্বজুড়ে সবার কাছে এ বইমেলা অসম্ভব জনপ্রিয়। ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতিবছর মার্চ ও এপ্রিলের চার দিন এ মেলা ইতালির বলগ্নায় অনুষ্ঠিত হয়। শিশুসাহিত্য, শিশুচলচ্চিত্র এবং অ্যানিমেশন নিয়ে যারা কাজ করেন, তারাই মূলত এখানে শিশুসাহিত্য সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করতে আসেন। এ ছাড়া এ মেলায় শিশুসাহিত্য, চলচ্চিত্র ও অ্যানিমেশন ইত্যাদিতে কৃতিত্ব রাখার জন্য মোট চারটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হয়। প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রকাশক মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন।
বুয়েন্স আয়ারস ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (আর্জেন্টিনা) : ১৯৭৫ সাল থেকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারস শহরে প্রতিবছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়। মেলাটি মূলত স্প্যানিশ সাহিত্য কেন্দ্র করে জমে ওঠে। অন্তত ৫০টি দেশের অংশগ্রহণে এ মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে। আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্সের প্রতিষ্ঠিত ‘ফান্দাসিঁও এল লিব্রো’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এ বইমেলার আয়োজন করে থাকে।
বুক ফেয়ার (হংকং) : হংকং ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় হংকং বইমেলা। হংকং বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। প্রতিবছর মধ্য জুলাইয়ে এ মেলা শুরু হয়। হংকং কনভেনশন অ্যান্ড এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত মেলার উদ্দেশ্য হংকংয়ের জনগণের জন্য কম দামে দেশি বা বিদেশি বই পৌঁছে দেয়া। এ মেলা মূলত আন্তর্জাতিক বই ব্যবসাকে উৎসাহিত করে। হংকংয়ে কমিকসের বই খুব জনপ্রিয়। এ কারণে এখানে আলাদাভাবে একটি কমিকস মেলাও অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক বইমেলা (আবুধাবি) : সাহিত্য পঞ্জিকার বড় মেলাগুলোর মধ্যে নতুন এই বইমেলাটি বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। সাহিত্য ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সহযোগে আবুধাবি কর্তৃপক্ষ এই মেলায় আয়োজন করে। এর মাধ্যমে আরব আমিরাত প্রকাশনা জগতের বৈশ্বিক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে চায়। বইয়ের শর্ত এবং অনুমতিপত্র ক্রয়ের দরাদরির জন্য এই মেলার গুরুত্ব অনেক। এছাড়াও আরবের ভাষা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান প্রকাশকদের জন্য এটি সর্বেশ্রষ্ঠ বইমেলা।
বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ) : অন্যান্য বইমেলার মতো বিইএ প্রতিবছর কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় হয় না, সারাদেশে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠিত হয়। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বার্ষিক মেলা, যা চারদিনব্যাপী চলমান থাকে। যদিও প্রতিবছর এর জায়গা পরিবর্তিত হয়, তবুও গ্রীষ্মের শুরুতে কোনো প্রধান শহরে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি প্রথমে শুরু হয়েছিল আমেরিকান বই বিক্রেতা সংঘ সম্মেলন এবং ১৯৪৭ এর বাণিজ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে-এর অন্যতম উদ্দেশ্য আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশককে সামনে নিয়ে আসা। বই কেনার খুচরা বিক্রেতা, এমনকি লাইব্রেরিয়ান এবং লেখকদের সুবিধানুযায়ী এ বইমেলা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়।
গুয়াদালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা (মেক্সিকান) : মেক্সিকান শহর গুয়াদালাজারা স্প্যানিশ ভাষার প্রকাশনা জগতের প্রধান অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। এ মেলা বইয়ের জগতের পেশাদারদের জন্য সবচেয়ে ভালো বাণিজ্যিক পরিবেশ নিশ্চিত করে, তেমনি পাঠকদের মনেও এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর গুয়াদালাজারা বিশ্ববিদ্যালয় এ মেলার আয়োজন করে আসছে। যার ব্যাপ্তি এখন মেক্সিকান শহর গুয়াদালাজারার প্রায় ৪০০০০ মিটার স্কয়ার জায়গাজুড়ে। এটি সাধারণত নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের শুরুতে ৯ দিন ধরে চলে।
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা (ভারত) : এশিয়ার প্রধান বইমেলা ও অবাণিজ্যিক দিক থেকেও কলকাতা বইমেলার গুরুত্ব অনেক। ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার দিক থেকে বিবেচনা করলে কলকাতা বইমেলার স্থান তৃতীয়। আড়াই লাখেরও বেশি পাঠক প্রতিবছর এ বইমেলা পরিদর্শন করতে আসেন। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এ বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। বর্তমানে জানুয়ারির শেষ বুধবার ১২ দিনব্যাপী এ বইমেলার উদ্বোধন হয়। মেলার বর্তমান আয়োজনস্থল পূর্ব কলকাতার মিলনমেলা প্রাঙ্গণ। প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতারা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের প্রকাশিত অথবা পরিবেশিত বইয়ের প্রচার ও বিক্রয়ের উদ্দেশে এ মেলায় যোগ দেন। বর্তমানে বইমেলাকে ‘বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ’ বলে অভিহিত করা হয়। কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের জন্যও একটি আলাদা প্যাভিলিয়ন থাকে।
নয়াদিল্লি বিশ্ব বইমেলা (ভারত) : কলকাতার পরে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বইমেলা হলো নয়াদিল্লি বিশ্ব বইমেলা। প্রায় দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারী নিয়ে ১৯৭২ সালে প্রথম এ বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এটি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট দ্বারা বছরে একবার আয়োজিত হয়। প্রতি বছর এক হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারী সমেত আয়োজিত এ বইমেলা এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইংরেজি ভাষার বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত। বছরের প্রথম দিকে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়।
যা ১৮ ভাষায় কাজ করা প্রায় ১২ হাজার প্রকাশকের দেশীয় প্রকাশনা জগতের জন্য বিশাল একক্ষেুত্র প্রস্তুত করে। এমনিভাবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত দর্শক ও প্রকাশক মিলে এটিকে সত্যিকারের একটি বিশ্বব্যাপী ইভেন্ট করে তুলেছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা (বাংলাদেশ) : একুশে বইমেলা হিসেবে বেশি পরিচিত এ মেলার আরেক নাম ‘প্রাণের মেলা’। প্রতিবছর বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলা এ বইমেলা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৪ সাল থেকে মেলার পরিধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত ব্যাপ্ত করা হয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে সেসব শহিদের প্রতি, যারা ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মতো শহিদদের উদ্দেশ্য করে বইমেলার আয়োজন বিশ্ব বইমেলার ইতিহাসে বিরল। একুশে বইমেলার সূচনা হয় ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায়। এ দিন চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা ৩২টি বই এক টুকরো চটের ওপর সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। মেলা চলাকালীন সারা মাস নজরুল মঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এ মেলার প্রবেশমূল্য নেই। মেলা প্রাঙ্গণ ধূমপানমুক্ত। প্রচুরসংখ্যক ক্রেতা-দর্শনার্থী মেলায় আসেন, বই দেখেন, কেনেন ও লেখককুঞ্জে তাদের প্রিয় লেখক-কবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মেলায় বই বিক্রি হয় কমিশনের মাধ্যমে। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গুণিজনদের বিশেষ সম্মাননা দিয়ে থাকে।