ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফেনী নদী থেকে আরাকান জয়

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
ফেনী নদী থেকে আরাকান জয়

১৩৪০ সালে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বৃহত্তর বাংলার (তৎকালীন সুবা বাংলা) অধীনে আসে। ১৩৪৬ সালে এ চট্টগ্রাম দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামকে বঙ্গ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত সুন্দর নগর হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রায় ২০০ বছর মুসলিম শাসনামলের পর ১৫১৩ সালে চট্টগ্রাম আবার বাংলার হাতছাড়া হয়। সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের আমলে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করে নেয়া হয়। যদিও ত্রিপুরার এ দখলদারিত্ব বেশিদিন বজায় ছিল না। অচিরেই সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের পুত্র সুলতান নশরত শাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় হয়। চট্টগ্রাম বিজয় করেই সুলতান অঞ্চলটির নাম দেন ‘ফাতেয়াবাদ’। আজও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ফাতেয়াবাদ অঞ্চলটি সুলতান নশরত শাহের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। চট্টগ্রাম-হাটহাজারি সড়কের ফাতেয়াবাদে অবস্থিত নশরত শাহ কর্তৃক খননকৃত বড় দিঘি এবং সুলতান নশরত শাহ মসজিদ আজও অস্তিত্বের জানান দেয়।

আরাকান রাজা কর্তৃক মোগল শাহজাদাকে হত্যার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম বিজয়ের উপলক্ষ তৈরি হয়। ১৬৫৭ সালে মোগল সিংহাসন নিয়ে বাদশাহ শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে সংঘটিত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে তার অপর ভাইয়েরা পরাজিত হন। তাদের একজন হলেন শাহ সুজা। তিনি ১৬৪০ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবেদার ছিলেন। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহ সুজার লক্ষ্য ছিল, নোয়াখালী থেকে জাহাজে করে সমুদ্রপথে মক্কা অথবা তুরস্কের ইস্তান্বুুলে চলে যাবেন। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পেতে শাহ সুজা সপরিবারে পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্যে আশ্রয় নেন। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহ সুজাকে খুন করে আরাকান রাজা। তার পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত, ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ।

মোগল শাহজাদার এ বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কাছে। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দিলে শায়েস্তা খান তার পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের নেতৃত্বের নির্দেশ দেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার সেনাপতি এবং দক্ষ প্রশাসক। তিনি বুঝলেন, চট্টগ্রাম বিজয় করতে হলে সমুদ্র এবং স্থল দুই পথেই আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। সমুদ্রপথে আক্রমণ করতে হলে দরকার নৌ-ঘাঁটি। আর এই নৌ-ঘাঁটি স্থাপনে জুঁতসই জায়গা হলো সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপে তখনকার শাসক সাবেক মোগল সেনাপতি দিলাওয়ার খাঁ মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ে সহায়তা করতে রাজি হননি। বাংলার নৌপথ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ছিল পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন মিস্টার মুরের। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল আরাকানি মগদের বন্ধুত্ব। অল্প সময়ের মধ্যেই উমেদ খাঁ কৌশলে পর্তুগিজ এবং মগদের মধ্যে বিবাদ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ফলে মোগলদের চট্টগ্রাম আক্রমণের সময় আরাকানদের কোনোরূপ সাহায্য করেনি পর্তুগিজরা। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে উমেদ খাঁ ক্যাপ্টেন মুরের কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সাহায্য নিয়ে সন্দ্বীপ দখল করেন। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের পুরস্কার হিসেবে বাদশাহ আওরঙ্গজেব বুজুর্গ উমেদ খাঁকে নবাব উপাধি দিয়ে চট্টগ্রামের শাসনভার প্রদান করেন। ফৌজদার হয়েই তিনি সমগ্র চট্টগ্রামকে অনন্যভাবে গড়ে তোলেন। তৈরি করেন সুদক্ষ প্রশাসনিক রাজস্ব ও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মোগলরা চট্টগ্রামে বহু স্থাপনাসহ মসজিদ নির্মাণ করে। রহমতগঞ্জ, হামজারবাগ, ঘাট ফরহাদবেগ, আসকার দীঘি, বাগমনিরাম, মোগলটুলী, পাঠানটুলী, বাগ-ই-হামজাহ মসজিদ, মিসকিন শাহ মসজিদ, কদম মোবারক মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামি মসজিদ, ওয়ালি খান মসজিদসহ অনেক স্থাপনা চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে মোগলদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়।

চট্টগ্রাম বিজয় করেই আরামণ্ডআয়েশ ভোগ করার জন্য বসে না থেকে মগদের পুরোপুরি চট্টগ্রাম ছাড়া করতে তিনি মোগল বাহিনীসহ চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে যাত্রা করেন। মগদের ক্রমেই চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে করতে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত পৌঁছান বুজুর্গ উমেদ খাঁ। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তিনি আর অগ্রসর হননি। আর চট্টগ্রাম থেকে রামু পর্যন্ত রসদ সরবরাহে কষ্ট হওয়ায় বুজুর্গ উমেদ খাঁ রামু থেকে কিছুটা পিছিয়ে শঙ্খ (সাঙ্গু) নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। এরপর দুর্গ স্থাপন করে সাঙ্গু নদ পর্যন্ত সীমানা কার্যকর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে দু’জন সেনানায়ক যথাক্রমে আধু খাঁ এবং লক্ষ্মণ সিংকে এ স্থানে মোতায়েন করেন। এ দুই সেনানায়কের অধীনে ছিল দু’হাজার সৈনিক। পরবর্তীতে এলাকাটির নামকরণ হয় দুইহাজারি বা দোহাজারি।

পরের বছর চট্টগ্রাম দখল করতে আরাকান থেকে আবার হামলা চালায় মগরা। সাঙ্গু নদী ও আশপাশের এরিয়ায় মোগলদের সঙ্গে মগদের চারটি যুদ্ধ হয়। সবগুলো যুদ্ধে জয়ী হয় মোগলরা। আধু খাঁর বীরত্বে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম মোগলদের করায়ত্ত হয়। আরাকান বাহিনীর সঙ্গে আধু খাঁর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় সাঙ্গু নদের ১৫ কিলোমিটার দূরে বর্তমান আধুনগর ও লোহাগাড়া স্থানে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার ‘আধুনগর’ আজও আধু খাঁর অস্তিত্বের জানান দেয়। আধু খাঁ বিজয়ের স্মারক হিসেবে যুদ্ধস্থানে একটা লোহা গেঁথে রাখেন। লোহা গেঁথে রাখা থেকে স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘লোহাগাড়া’। সাঙ্গু নদের পাড়ে আরাকানের মগদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত ২২ জন মোগল সৈন্যকে রাজকীয়ভাবে দাফন করা হয় চন্দনাইশের হাশিমপুরে আরাকান মহাসড়ক সংলগ্ন বাগিচাহাট (বাগ-ই-শাহ) নামক এলাকায়। বাংলার অবিচ্ছেদ্য অঞ্চল চট্টগ্রাম পুনর্দখলের জন্য আরাকানি মগরা পরে অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি।

সর্বশেষ ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে বিশাল এক বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে অগ্রসর হলে মোগলরা আরাকানি মগদের নাফ নদ পর্যন্ত বিতাড়িত করেন। মোগলরা আরাকানে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেও বর্ষাকাল আর বিপদশঙ্কুল মনে করে আরাকানে প্রবেশ না করে নাফ নদকে সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করেন। এরপর আরাকান রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে একটি ছোট্ট অঞ্চলে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খলার সুযোগে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদপায়া আরাকান আক্রমণ করেন। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী (থেরবাদি) হলেও মায়ানমারের বৌদ্ধদের থেকে তারা নিজেদের পৃথক জাতিসত্তা বলে মনে করে। ফলে যুগ যুগ তারা বর্মি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে। বর্মি বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাখাইন মগ, রোহিঙ্গা মুসলিম নির্বিশেষে আরাকানের জনগণ পালিয়ে এসে রামু, কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্মিদের বিতাড়িত করে আরাকান দখল করে নিলে সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। এ সময় হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল।

এমনিতে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম আর রাখাইন মগদের সংখ্যা ছিল সমানে সমান। তার ওপর দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর বাঙালি মুসলমানের অভিবাসনের ফলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হয়। ফলে রাখাইনদের মাঝে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়; যা দীর্ঘমেয়াদি রাখাইন-রোহিঙ্গা সংঘাতের জন্ম দেয়। এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯৩৭ সালের প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় মিয়ানমারের করদরাজ্য হিসেবে আরাকানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করলে ১১১ বছর পর আরাকান বাংলার হাতছাড়া হয়। না হয় আরাকানের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। অর্থাৎ ফেনী নদী থেকে আরাকানের ইরাবতী নদী পর্যন্ত চট্টগ্রামের সীমানা হতো। বুজুর্গ উমেদ খাঁর নেতৃত্বে বিজয়ের পর চট্টগ্রাম আর কখনও বাংলার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক আওতার বাইরে যায়নি। মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান যখনই যার শাসনে ছিল, চট্টগ্রাম সব সময়ই বাংলার সঙ্গে ছিল এবং আছে। যার বিজয় না হলে হয়তো রোহিঙ্গাদের মতো ফেনী নদীর তীরে আমাদেরও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো, সেই বুজুর্গ উমেদ খাঁর খবর ক’জনই রাখে!

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত