আরবদের গৌরবময় ইতিহাস এবং গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অবশ্যই আরব জাহান এখনও বিশ্বনেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সমগ্র পৃথিবীকে প্রভাবিত করার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে। নতুন বিশ্ব-বিপ্লব, ইসলামের উত্থান ও নবজাগরণের জন্য আরবজাহান ও মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে অধিক উপযোগী আর কোনো জনপদ হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আরববিশ্ব ও আরবজাতিই আজ হীনমন্যতা ও আত্মবিস্মৃতির সবচেয়ে বড় শিকার। মুসলিম উম্মাহর এ চরম সঙ্কটাপন্ন সময়ে তাদের পরিবেশই সবচেয়ে বেশি নীরব, নির্বিকার। তাদের জীবন-সমুদ্রই সবচেয়ে বেশি নিস্তরঙ্গ। কোথাও কোনো দ্বীনি তড়প ও অস্থিরতা এবং হিম্মত ও চঞ্চলতার চিহ্নমাত্র নেই। অথচ এখান থেকেই একসময় মানুষ নতুন জীবন, নতুন ঈমান লাভ করেছে। এখান থেকেই অর্ধ পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে। আর আজ তাদের উত্তরসূরিরাই দুর্বল, পশ্চাৎপদ, পরাধীন, যুগের দুর্যোগ ও বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের সামনে অসহায় এক জাতিতে পরিণত হয়েছে।
চুপ থাকার প্রধান কারণ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘এমন এক যমানা আসবে, কাফেরের সামনে তোমরা তুফানের বুদবুদের ন্যায় ভেসে যাবে।’ সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে সময় কি মুসলমানদের সংখ্যা কম হবে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘না! তোমাদের সংখ্যা অধিক হবে; কিন্তু তোমাদের অন্তরে ওহান ঢেলে দেয়া হবে।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহান কী?’ উত্তরে বললেন, ‘দুনিয়ার মহব্বত ও মৃত্যুর ভয়।’ রাসুল (সা.)-এর বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে। স্বার্থের তাগিদে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে আজ আরব প্রধানরা পশ্চিমাদের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। বিশ্লেষকরা তো তা-ই বলছে। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী আরব দেশগুলোর কেউ কেউ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় আছে। নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। সংগত কারণেই তারা হয়তো মনে করে, পপুলার সেন্টিমেন্ট যা-ই হোক, ইসরায়েলকে ঘাঁটানো তাদের ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না। সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, মুসলিম দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না। প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল আরব জনপদের বর্তমান ও অতীতের মধ্যে তুলনা করে দরদণ্ডব্যথায় একাকার হয়ে কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, হেজাজের কাফেলায় আজ নেই কোনো হোসাইন, যদিও দজলা-ফোরাত আগের ন্যায় বয়ে যায় বিরামহীন।
সমাধান যে পথে : কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে হলে, বিশ্বমঞ্চে আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইলে নিশ্চয় আমাদের গোড়া থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। আবারও ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে। ঈমানি পরিবেশে, ঈমানি তারবিয়াত গ্রহণ করে ঈমানি শক্তি বাড়াতে হবে। কারণ, ঈমানই মুসলিম জাতির মূল শক্তি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হও।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৯)। এ আয়াতটি ওহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। যখন মুসলিম মুজাহিদগণ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল, তাদের বড় বড় বীর পুরুষদের লাশগুলো চোখের সামনে নাক-কান কর্তিত অবস্থায় পড়েছিল, রাসুল (সা.)-কেও পাষ-রা আহত করে দিয়েছিল, বাহ্যত মুসলমানদের চূড়ান্ত পরাজয়ের আয়োজন দেখা যাচ্ছিল, এমন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে আল্লাহতায়ালার আশ্বাস বাণী শুনিয়ে দেয়া হলো, শুনে রাখ! যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নিমর্মতায় ঘাবড়ে গিয়ে আল্লাহর দুশমনদের মোকাবিলায় কোনো ধরনের কাপুরুষতা ও দুর্বলতা প্রদর্শন কর না। বিপদাপদে পড়ে, দুঃখ-চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া মোমিনের জন্য শোভা পায় না। মনে রেখ! আজও তোমরাই বিজয়ী ও সম্মানিত। কেননা, দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য তোমরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছ। তাই চূড়ান্ত বিজয় তোমাদের জন্যই। তবে শর্ত হলো, ঈমান ও বিশ্বাসের ওপর অবিচল থাকতে হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। খোদায়ি এ আওয়াজ মুসলমানদের ভগ্ন হৃদয়কে শক্তিশালী করল। মৃত দেহে নব জীবন সঞ্চার করল। ফলে বাহ্যদৃষ্টিতে এর আগের বিজয়ী কাফেররা আঘাতপ্রাপ্ত মুজাহিদদের প্রতি-আক্রমণ সামলে উঠতে পারল না। রণাঙ্গন থেকে দিশাহারা হয়ে পালাতে বাধ্য হলো। (তাফসিরে উসমানি)। ঈমানের ওপর অবিচল থাকলে সময়ের পালাবদলে ফিলিস্তিনিরাও স্বীয় মাতৃভূমিকে ফিরে পাবে। একদিন নিশ্চয় দখলদারেরা পরাভূত হবে। গাজা, রামাল্লা, নাবলুস বা পশ্চিম তীরের রণাঙ্গনগুলো সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে আসবে। ইতিহাস তো তা-ই বলে। এ ফিলিস্তিনের ভূমিতেই একসময় কিশোর ডেভিড পাথর ছুড়ে মহাপরাক্রমশালী অত্যাচারী শাসকের যোদ্ধা গোলাইয়াথকে বধ করেছিল। সেই ডেভিড আজ হাজারো ডেভিডে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনে হাজারো ডেভিড পাথর ছুড়ে যাচ্ছে। কিশোর ডেভিডের মতোই ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরেরা ইসরায়েল নামক গোলাইয়াথকে বধ করবে। ফিলিস্তিনিরা আকাশ সেদিন ‘আজাদ ফিলিস্তিন,স্বাধীন ফিলিস্তিন’ শব্দে প্রকম্পিত হবে।