ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি একটি নতুন সংকটে জড়িয়েছেন। নিজ দেশে দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন তিনি। পাশাপাশি গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখোমুখি নেতানিয়াহু। এবার তিনি বিশ্বাসঘাতকতার গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ব্যাপারে তথ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
৭ অক্টোবরের ঘটনার পেছনে যার হাত : ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও জনগণের একাংশ আগে থেকেই দাবি করে আসছিলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলির মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও দায়িত্বে থাকা সেনাদের সাক্ষ্যে জানা যায়, ‘হনিবাল ডিরেকটিভ’ জারি করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজ নাগরিক ও সেনাদের হত্যা করে। যেন তারা হামাসের হাতে না পড়ে। অন্য কথায়, নেতানিয়াহু কেবল হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্যই দায়ী নন, বরং তার নিজ সৈন্যদের হত্যার জন্যও দায়ী।
‘কাতারগেট’ তদন্ত যা বলছে : সর্বশেষ ঘটনাটি আগের অভিযোগগুলোর চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিনবেত বিষয়টি নিয়ে এক তদন্ত পরিচালনা করে। ‘কাতারগেট’ নামে পরিচিত এ তদন্তের ভিত্তিতে আরও গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে নেতানিয়াহু ও তার কার্যালয়ের বিরুদ্ধে। শিন বেত-এর এক তদন্তে উঠে আসে, নেতানিয়াহু ও তার উপদেষ্টারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। তবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে তা জানানো হয়নি। এমনকি গাজার বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য কাতার থেকে যে অর্থ হামাসের কাছে পাঠানো হয়েছিল, সেই অর্থের কিছু অংশও আত্মসাৎ করা হয়েছিল। কারণ, অর্থগুলো নেতানিয়াহুর উপদেষ্টাদের মাধ্যমেই পাঠানো হয়েছিল। নেতানিয়াহু ও তার উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে শিন বেতের এ তদন্তই মূলত ‘কাতারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত। এ তদন্ত ফাঁস হওয়ার পর ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আমান এবং চিফ অব স্টাফ তাদের ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে নেতানিয়াহু শিনবেত প্রধান রোনেন বার-এর পদত্যাগ দাবি করেন। তবে বার পদত্যাগ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করে আসছেন। তাই এ মুহূর্তে পদত্যাগ করা তার পক্ষে উপযুক্ত হবে না।
নেতানিয়াহু বনাম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান : নেতানিয়াহু জানান, তিনি বারের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। তাকে তিনি বিশ্বাস করেন না। তাই তাকে বরখাস্ত করতে চান। এমন অবস্থায় দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, শিনবেত প্রধানের পদটি ব্যক্তিগত আস্থার ভিত্তিতে নয়। তাই কেবল ‘অবিশ্বাস’ ও ‘আস্থাহীনতা’ বরখাস্তের জন্য যথেষ্ট নয়। পরে ইসরায়েলের সুপ্রিমকোর্টও সিদ্ধান্ত দেয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু বার-কে বরখাস্ত করতে পারেন না। এরপরও নেতানিয়াহু আদালতের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বার-কে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়ে তদন্ত বন্ধের নির্দেশ দেন।
ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে : নেতানিয়াহুর এ সিদ্ধান্তকে অনেকেই ইসরায়েলের গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখছেন। এরই মধ্যে তেল আবিবে ২ লাখেরও বেশি মানুষ তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। পাশাপাশি দেশটির বিরোধী দলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদ ইসরায়েলি জনগণকে অসহযোগ আন্দোলনে আহ্বান জানিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হামাস বা ইরান নয়, বরং নেতানিয়াহু নিজেই।’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, নেতানিয়াহু পদত্যাগ না করলে দেশ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
বিচার বিভাগেও হস্তক্ষেপ : শুধু শিন বেত প্রধানই নয়, নেতানিয়াহু সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ কমিটির কাঠামোও বদলাতে চাইছেন। এ কমিটি বর্তমানে বিরোধী পক্ষের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ হলেও একে সরকারের অনুকূলে আনতে চান তিনি।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও আসন্ন : সবকিছু মিলিয়ে ইসরায়েলে রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও প্রবল। বিশ্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুডিস গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের ক্রেডিট রেটিং দুই ধাপ কমিয়ে দিয়েছে। সংস্থাটি জানায়, ইসরায়েলের ‘রাজনৈতিক সংকট ও নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা’ অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। চলমান যুদ্ধ লেবানন, সিরিয়া এমনকি ইরানেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দেশটির অর্থনীতি দেউলিয়াত্বের মুখে পড়তে পারে। সব মিলিয়ে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে শিনবেত প্রধানকে অপসারণ চেষ্টার মতো রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ইসরাইলকে একদিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ধসের মুখোমুখি করছে। ইসরায়েলিদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা এক যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর সঙ্গে থাকবেন নাকি গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন?
ইসরায়েলিদের প্রতিক্রিয়া : অবশ্য এরই মধ্যে ইসরায়েলি জনগণ তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিবে ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাসের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন করার দাবিতে তেল আবিবে ইহুদি বন্দিদের পরিবারগুলো বিক্ষোভ করেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, পুলিশ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বিক্ষোভকে বৈধ বলে মনে করেনি। তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য বলপ্রয়োগ করেছে। পরে শনিবার রাতে ইসরায়েলি গণমাধ্যম দেশটির সংসদ নেসেটের কাছে ইসরায়েলি পুলিশ বাহিনী এবং ইহুদিবাদী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার রাতেও হাজার হাজার মানুষ তেল আবিবের রাস্তায় নেমে বন্দি বিনিময় বিষয়ে নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়। তারা বন্দি বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে এবং শিনবেত প্রধান ও মন্ত্রিসভার আইন উপদেষ্টাকে অপসারণ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করে। অন্যদিকে অধিকৃত অঞ্চলের বেশির ভাগ বাসিন্দা নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার কর্মক্ষমতা নিয়ে অসন্তুষ্টির কারণে আগাম নির্বাচন চেয়েছেন।
সম্প্রতি ইসরায়েলের টিভি চ্যানেল-১৩ দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, অধিকৃত অঞ্চলের ৫৯.২ শতাংশ বাসিন্দা মনে করেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ব্যক্তিগত কারণে শিনবেতের প্রধান এবং মন্ত্রিসভার আইনি উপদেষ্টা রোনেন বারকে বরখাস্ত করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫.৭% যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন।