গাজা শহরের উত্তর-পশ্চিমে আল-কারামা এলাকায় বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা রুবা (২২)। যুদ্ধের পর বিয়ে হয়েছে তার। নতুন বউ- সংসার জীবন শুরু করেছেন তাঁবুতে। এক চিলতে সংসার, ছোট্ট একটু জায়গা- রীতিমতো একঘেয়ে জীবন কাটছে তার। কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো উচ্ছ্বাস। সর্বক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটছে সময়। ঘিঞ্জি পরিবেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে। তাঁবুর ভেতর বন্দি জীবন নিয়ে রুবা বলেন, ‘আমি বিয়ে করেছি, কিন্তু আমার কোনো আনন্দ নেই। আমার জীবন আমার মতো করে কাটাতে পারছি না। তাঁবুর ভেতরে সবকিছুই ভাঙা। কোনো আরাম নেই।’
শুধু রুবা নয়, এ গল্প গাজার সব নারীদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় নারীর স্বভাবসিদ্ধ গোপনীয়তাণ্ডআড়ষ্ঠতা, সাজানো সংসার, নিভৃত স্বাধীনতা, নির্জন অবসর- এসবই এখন হারানো অতীত; কল্পরাজ্যের রূপকথা। বদলে জুটেছে অভাব-দৈনতা আর ইসরায়েলি আগ্রাসনে ‘দুমড়ে-মুচড়ে’ যাওয়া জরাজীর্ণ তাঁবু ঘরের শীর্ণ নারী জীবন। সুখমহল থেকে শরণার্থী শিবির। ইসরায়েলের বুলেট-বারুদণ্ডবোমায় সংসারের ছাদণ্ডবারান্দার মতোই ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে গাজার শৌখিন নারীত্ব।
সময় যত যাচ্ছে ইসরায়েলের চলমান হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে বাস্তুচ্যুত নারীদের জীবন। তাঁবুর ভেতর থাকায় পোশাক পরিধানসহ নানাবিধ কারণে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষসহ বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একই তাঁবুতে থাকতে হচ্ছে নারীদের। এমনকি মাত্র একহাত দূরে থাকছে অপরিচিতদের তাঁবু; যা অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর। নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হচ্ছে শৌচাগার। ডজনখানেক লোকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হচ্ছে অস্থায়ী টয়লেটগুলো। একই অবস্থা গোসলখানাগুলোরও। স্বাস্থ্যবিধি পণ্যগুলোর প্রবেশ সীমিত থাকায় অনেক নারী স্যানিটারি প্যাড হিসেবে চাদর বা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করছেন।
অবরুদ্ধ গাজায় তাঁবুর ভেতর দুঃসহ জীবন কাটানো এমন আরেক নারী বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা উম্ম উবাইদা (৩৫)। স্বল্প জায়গায় দৈনন্দিন বাঁধা-ধরা নিয়মে মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত সে। উবাইদা বলেন, ‘প্রতিদিন রান্না করায় আমাদের হাত রুক্ষ হয়ে গেছে। আগুনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার ফলে আমাদের ত্বক কালো হয়ে গেছে। সহজে পরিবর্তন করা যায় বিধায় আমি এখন শুধু আমার নামাজের গাউনটি পরি। এটি তাঁবুতে সবচেয়ে উপযুক্ত।
আমি মেকআপ সম্পর্কে পুরোপুরি ভুলে গেছি।’
একই বিষণ্ণতা দেখা গেছে খান ইউনিসের মাওয়াসি পাড়ায় বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা রাশা শাবির (২৫)। যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার হাত-পা-ত্বক। তিনি বলেন, ‘আগে আমি মেকআপ ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে থাকতাম। চুল, বডি মাস্ক এবং নেইল পলিশের জন্য প্রচুর ব্যয় করতাম। কিন্তু এখন আমার ত্বক ও হাত পুরুষদের হাতের মতো দেখাচ্ছে।’ নখ থেকে ছাই পরিষ্কার করতে করতে তিনি আরও বলেন, ‘আগুনের সামনে বসায় আমার চেহারাটা প্রায় পুড়েই গেছে। আমার বয়স মাত্র বিশ; অথচ এখনই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখ। পাশাপাশি বলিরেখা বাড়ছে। আমরা তাঁবুর ভেতরে আমাদের নারীত্ব হারিয়ে ফেলেছি।’
মনোবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী নিবাল হালাস বলেন, ‘তাঁবুতে বসবাস করা নারীদের ওপর মারাত্মক মানসিক ও সামাজিক প্রভাব পড়ছে।’ জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক নারী আমাদের প্রতিদিন জানাচ্ছেন, তাদের চুল আঁচড়ানোর জন্য সময় বা সঠিক পরিবেশ নেই। যুদ্ধ তাদের মৌলিক জীবনের অগ্রাধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে।’
ইউএন উইমেন রিপ্রেজেন্টেটিভ মেরিসে গুইমন একটি ব্লগ পোস্টে বলেছেন, ‘গাজার নারীরা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত এবং অসুস্থ। তারা ক্রমাগত ভয় এবং ক্ষতি সত্ত্বেও পরিবার নিয়ে থাকছে। ১০ হাজারেরও বেশি নারী তাদের জীবন হারিয়েছে। ৬ হাজারেরও বেশি পরিবার তাদের মাকে হারিয়েছে। প্রায় ১০ লাখ নারী ও মেয়ে তাদের ঘরবাড়ি, প্রিয়জনকে হারিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন বাস্তুচ্যুত এবং প্রায় ১০ লাখ নারী ও মেয়েরা অর্থ বা জিনিসপত্র ছাড়াই কমপক্ষে পাঁচবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারা কোথায় যাবে বা কোথায় থাকবে, জানে না। গাজার জনাকীর্ণ তাঁবু ক্যাম্পগুলো নারীদের জন্য অবিরাম সংগ্রাম।’